Tuesday, January 22, 2013

এপয়েন্টমেন্ট লেটার

আমার হাতে এখন আমার প্রথম চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার। মামা, চাচা, খালু বা কোনো লিংকের জোড়ে নয়, বরং নিজের যোগ্যতায় পাওয়া প্রথম চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার। আমি আমার লাইফে এই পর্যন্ত একটি ইন্টারভিউই দিয়েছি। এবং প্রথম ইন্টারভিউতেই আমার চাকরিটা হয়েছে। আমি জানি না, এরকম ভাগ্য নিয়ে সবাই পৃথিবীতে আসে কিনা। তবে আমি এসেছি ... এই সৌভাগ্য কয়জনের হয় আমার জানা নেই। তবে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। হয়তোবা অনেকের দোয়া আছে আমার উপর, কিন্তু আমি ওসব বিশ্বাস করি না। আমি আমার জীবনে এমন কিছুই করিনি যে এতোটাই দোয়া পাবো।

এই চাকরিটার জন্য আমার মোট দুইবার ইন্টার্ভিউ দিতে হয়েছে। ভার্সিটির জব ফেয়ারের শেষ দিন আমি জানতে পারলাম, ২৫ টার মতো নামিদামী কোম্পানি এসেছে। সেদিনই ছিলো সিভি জমা দেওয়ার শেষ দিন। আর তখনো আমার নিজস্ব কোন সিভি বানানো ছিলো না। আমি আসলে জানতামই না, ভার্সিটিতে যে জব ফেয়ার চলছে। যখন জানতে পারলাম, তখন বাজছিল ১১.৩০। সিভি জমা দেওয়ার শেষ সময় বিকাল ৪ টা। আমার সদ্য ফরমাল ড্রেসে পড়া কোন ছবি তোলা ছিলো না, যে দুই কপি তোলা আছে তা ইন্টার পাস করার পর টি -শার্ট পড়া অবস্থায় তোলা। আর তা ও সাথে নেই, আছে বোনের বাসায়। সিভিও করা নেই। ১২ থেকে ৩ টা পর্যন্ত ক্লাস। আর রগ কাটার কারণে বাম হাত প্লাস্টার করা অবস্থায় গলায় ঝুলানো....

আমি আমার সিভি তৌরি করেছিলাম ৪ টা বাজার ৪০ মিনিট আগে ... টি শার্ট পড়ে তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবি সংবলিত ২৫ কপি সিভি প্রিন্ট করতে করতে বেজে গিয়েছিল ৩ টা ৫০। তারপর প্লাস্টার করা হাত নিয়ে দৌড় ... পিছন থেকে শুনলাম কে যেন বলে উঠলো, "Run Forest, Run..." মনের ভুলও হতে পারে ...

দেড়িতে সিভি জমা দেওয়ার কারণে হোক, CGPA কম থাকার কারণে হোক, বা টি শার্ট পড়ে তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবির থাকার কারণেই হোক ... আমাকে মাত্র একটি কম্পানি থেকে কল করা হলো। বলা হলো তারপরের দিন ইন্টার্ভিউ। আমি ডাক্তারের নিষেধ থাকা স্বত্বেও প্লাস্টার খুলে গিয়েছিলাম ইন্টার্ভিউতে। বাম হাত নাড়াচাড়া করতে পারছিলাম না রগ টান খাওয়ার কারণে। তারপরও তিন ঘন্টা চুপচাপ বসে ছিলাম প্রথম ইন্টার্ভিউ দেওয়ার জন্য ... বা চাকরিটা পাবার আশায় ...

ঐ কোম্পানি আমাদের ভার্সিটি থেকে মাত্র ৮ জন সিলেক্ট করেছিল প্রথম ইন্টার্ভিউয়ের জন্য। এক এক জনের ইন্টার্ভিউ নিচ্ছিল ১৫ মিনিট করে। আমি ছিলাম সবার শেষে .. আমিও দিয়েছিলাম... আমাকে ইন্টারভিউ শেষে বলা হয়েছিল, "আরেকটা ফাইনাল ইন্টার্ভিউয়ের জন্য হয়তোবা আপনাকে ডাকা হতে পারে, আপনি আসতে পারবেন তো? "
আমি বলেছিলাম, "অবশ্যই স্যার, আমি আপনাদের কলের অপেক্ষায় থাকবো "
আমি অপেক্ষায় থাকিনি। ১৫ দিনের মতো অপেক্ষায় থাকার পর আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম একেবারেই। বাপের পরিচয়ের লিঙ্ক ধরে ঔষুধ কোম্পানিতে ঢুকার একটা অফারও পেয়েছিলাম। মন একেবারেই টানছিল না, কিন্তু সবার একটাই কথা .."এই যুগে লিংক ছাড়া চাকরি প্রধানমন্ত্রীও নাকি পায় না "। আর আমি কোন ... ... আবদুল্লাহ?

প্রথম ইন্টার্ভিউয়ের ঠিক এক মাস ৫ দিন পর ১৪ তারিখ সন্ধ্যায় সেই অনাকাঙ্ক্ষিত কলটি এসেছিল। আমাকে বলা হলো, ১৬ তারিখ ফাইনাল ইন্টার্ভউয়ের জন্য আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। ইন্টার্ভিউয়ের দিন যেয়ে দেখলাম ৪ টা টপ অর্ডারের ভার্সিটি থেকে মাত্র ৯ জনের মতো সিলেক্ট করা হয়েছে, যার মধ্যে ৪ জন শুধুমাত্র আমাদের ভার্সিটিরই!! গর্ব করার মতোই জিনিস, তবে গর্ভের চাইতে যেটা বেশী কাজ করছিল, সেটা হলো 'ভয় '। কারণ বাকি তিন জনের মধ্যে ২ জনই আমার পরিচিত ছিলো। একজনের সিজিপিএ ছিলো ৩.৫ এর উপরে আর একজন ছিল এক স্যারের টি.এ। আর একজন যে ছিল, সে ছিল 'রেডিও আমার' এর প্রাক্তন R.J.। আর আমি আবুল T.A ও ছিলাম না, আবার R.J ও না। আর আমার সিজিপিএ না হয় আপনাদের না ই বললাম। শুধু এতোটুকু বলি তাদের তুলনায় অনেক অনেক কম। কিন্তু আমার একটি জিনিস হয়তোবা তাদের চাইতে অনেক বেশী ছিলো, আর তা হচ্ছে 'আত্মবিশ্বাস '। আর আজকে হয়তো সেই আত্মবিশ্বাসের কারণেই আমার হাতে আমার প্রথম চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার .... কিংবা তথাকথিত ভাগ্যের জোড়ে।

সামনের মাসের ২ তারিখে আমার জয়েনিং ডেট। আপনাদের কাছ দোয়া চাই। চাকরিতে টিকে থাকার দোয়া না, বরং আত্মবিশ্বাস থেকে যেন কখনো ছিটকে না যাই তার দোয়া।

Wednesday, January 9, 2013

আকাংখা...

আমি কিছুদিন আগে হাস পাপিস থেকে একজোড়া স্যান্ডেল কিনেছি, দাম নিয়েছে মাত্র ৫৯৯০ টাকা। ২ ঘন্টা ধরে খুত খুত মনে ঘুরাঘুরি করে এই স্যান্ডেল জোড়াই পছন্দ হয়েছিল। আর হবেই বা না কেন, Hush Puppies বলে কথা!! বিল ক্লিনটনের মাই লাইফ অটোবায়োগ্রাফিতে পরেছিলাম বিল ক্লিন্টনের Hush Puppies এর জুতার প্রতি দূর্বলতার কথা। আর সেই একই ব্রান্ডের স্যান্ডেল এর প্রতি আমার যে কোন প্রকার দূর্বলতা থাকবে না তা বললে ভুল বলা হবে। আমার ধারণা সবারই থাকে... আমার বাবারও ছিল... এক জোড়া স্যান্ডেল এর প্রতি দূর্বলতা ...

আমার দাদি যখন মারা যায় ২০০৪ সালে আমরা তখন কুমিল্লায় থাকতাম। আর আমার দাদী ছিল চাদপুরে, আমাদের দেশের বাড়িতে। আমার তখন ২য় সাময়িক পরীক্ষা চলছিল। পরদিন ছিল ধর্ম পরীক্ষা। পরীক্ষা বাদ দিয়ে সেদিন রাতের বেলাতেই আমার মা আমাকে আর আমার বোনকে নিয়ে চাদপুরের উদেশ্যে রওনা হয়েছিল। আমরা আমাদের দাদীকে 'দিদা ' বলে ডাকতাম। বাসে বসে দিদার কথা খুব করে মনে করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু তেমন কিছুই মনে পড়ছিল না। শুধুমাত্র ঈদের বন্ধের সময়ই বাড়িতে যাওয়া হত বলেই মনে হয় তার কোন স্মৃতি আমার মাথায় সেভাবে গেথে যায়নি, শুধুমাত্র একটা স্মৃতি ছাড়া ... সেই স্মৃতিটাই বার বার তাড়া দিচ্ছিল মাথার ভিতরে ... ঠিক যেমন আজ দিচ্ছে ...

আমাদের দিদা আমাকে আর আমার বোনকে পেলে আমার বাবার ছোটবেলার একটা ঘটনা প্রায়শই বলতেন আর ঘটনা একটা পর্যায়ে এস ঢুকরে কেঁদে উঠতেন। আমার বাবা তখন নাকি প্রাইমারীতে পড়তেন। খালি পায়ে স্কুলে হেটে যেয়ে ক্লাস করতেন, একজোড়া জুতা ছিল না বিধায়। একদিন বাজারে একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল দেখে নাকি বাবার চোখজোড়া চক চক করে উঠেছিল। বাসায় আরো ৭ ভাইবোনের মধ্যে বড় আমার বাবা সেদিন অভাবের সংসার দেখে কাউকেই বলার সাহস পায়নি। একদিন সাহস করে আমার দিদার কাছে স্পঞ্জের স্যন্ডেলজোড়ার কথা বলতেই দিদা বলেছিলেন বাবার বড় চাচার কাছ থেকে চেয়ে দেখতে, তিনি হয়তো না করবে না। আমার বাবাও সংশয় নিয়ে বলেছিলেন তার চাচাকে। মুখ ফুটে বলা মাত্র উনার চাচা আমার বাবাকে বলেছিলেন, "বাপ ডাক, তাহলে কিনে দিব "। আমার প্রাইমারি পড়ুয়া বাবা কিছুই না বলে খালি পায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আবার ছুটে গিয়েছিলেন আমার দিদার কাছে। যেয়ে কিছুই না বলে বসে ছিলেন মুখ গোমড়া করে। দিদা কারণ জিজ্ঞাসা করতেই খুলে বলেছিলেন চাচার কথা। দিদা দুষ্টামি ধরতে পেরেই বাবাকে বলেছিলেন উনার দুষ্টামীর কথা, আর সাথে অনুমতিও দিয়েছিলেন যা বলতে বলেছিলেন তা বলার জন্য।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার দিদা ঠিক এই পর্যন্ত এসেই কেঁদে দিতেন বাচ্চাদের মতো .. তারপর সেই কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলতেন আমার বাবার একজোড়া শখের স্পঞ্জের স্যান্ডেল পাওয়ার বাকি অংশটুকু ...

আমার বাবা সেদিন স্পঞ্জের স্যান্ডেল জোড়া ঠিকই বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। তবে তা পায়ে দিয়ে না ... কাগজে মুড়ে বগলের তলায় শক্ত করে রেখে... যাতে নষ্ট না হয়ে যায়।

আমার বাবা একসময় সফল ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আজ পর্যন্ত ৬০০০ টাকার স্যান্ডেল পড়েননি। আমি আজ পড়লাম। হয়তোবা যেদিন আমার বাবার মৃত্যু হবে সেদিনও পড়বো এই স্যান্ডেলগুলো। তারপরও হয়তোবা আমার বাবার মতো কখনোই হতে পারবো না...