প্রিয়তমেষু রাজু ওরফে রাজা,
বদনারও যে নাম থাকে তা আগে কখনো লক্ষ্য করি নাই। আজকে করলাম। বোনের বাসায় দুইটা বাথরুম আছে। একটায় বদনা আছে, আরেকটায় নাই। যেটায় আছে ঐটার বদনার নাম হইলো গিয়া 'রাজা '!! বিশ্বাস হচ্ছে না? না হউয়ারই কথা। 'সাগর ' নামে কোন বদনা থাকলে সেটা আমার কাছে অবিশ্বাস্যই ঠেকাবে। যাই হোক আমি তোমাকে ঐ ভাঙ্গা বদনার ছবি তুলে পাঠাবো। হয়তোবা এতে তোমার কিছু যায় আসবে না, কিন্তু আমার আসবে। আমি অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও মাথা ঘামাই, অযথাই। একটা সময় ছিল যখন একটা মেয়ের পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়া ধুলোও সংরক্ষণ করার জন্য মন আঁকুপাঁকু করতো। ওই সময়ের ওই দিনগুলোতে ওই মেয়েটির থেকে পাওয়া বা কুড়িয়ে নেওয়া কিছু জিনিসের ফিরিস্তি দিলে তুমি হয়তোবা কিছুটা আচঁ করতে পারবা। আমার একটা বাক্স আছে, ঐটাতে আমি ঐ মেয়েটার থেকে পাওয়া (বিশেষ করে ব্যাবহার করে ফেলে দেওয়ার মতো জিনিসপত্র) জিনিসপত্র রাখি। বিভিন্ন বদনার মতো আমার অই বাক্সটারও একটা নাম আছে, 'তন্দ্রা বিলাস '। ঐ বাক্সটায় ভাঙ্গা চুলের ক্লিপ থেকে শুরু করে হাতের নখ পর্যন্ত আছে। ঐ মেয়েটার খেয়ে বেচেঁ যাওয়া পপকর্ণ সুন্দর করে প্যাকেট করা আছে। গত চারবছরে পপকর্ণ গুলো একেবারে চিপসে কালচে দাগ পরে গেছে। একটা টুরিস্ট চকলেটের খালি প্যাকেট টিস্যু দিয়ে পেচিয়ে রাখা আছে। একবার সে আমাকে পেভিসন ঔষুধ কিনে দিয়েছিল। সেটা আমি ব্যাবহার না করে রেখে দিয়েছিলাম বাক্সটিতে। আমার ওয়ারিদ নাম্বারটা ও কিনে দিয়েছিল, অই প্যাকেটাও আছে ওখানে। একটা আংটির ছোট বাক্স আছে ওখানে। ওটাতে আংটি না থাকলেও একটা ভাঙ্গা মাথার ক্লিপ, একটা ক্লোরমিন্টের খালি প্যাকেট, একটা দলা মোচড় হয়ে যাওয়া টিস্যু, একটা চুল, আর একটা আধ খাওয়া সিগেরেটের টুকরো আছে। সিগেরেট টা সে আমার জন্মদিন উপলক্ষে খেয়েছিল। একটা প্যাকেটে ২৩ টা স্ট্র রাখা আছে যা দিয়ে সে একসময় কোল্ডড্রিংস্ক খেয়েছিল। একদিনে না অনেক দিন লাগিয়ে খেয়ে থাকা স্ট্র...আর আছে অনেক কাগজে বানানো নৌকা, বাক্স আর রং বেরঙ্গের প্লেন...আরো অনেক কিছুই আছে যা তোমাদের ভাষায় হয়তো অর্থহীন ছাগলামি, কিন্তু কারো কারো কাছে ওগুলোর আলাদা একটা অর্থ আছে। যে অর্থ হয়তো একটা টোকাইকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের পরিত্যক্ত জিনিস খুজে পাওয়ার আনন্দ দিয়ে থাকে। যে আনন্দের সিকি ভাগও হয়তোবা তোমরা কখনো বুঝতে পারবা না।
৫ বছর আগে যখন তোমাদের আর আমাদের পরিবারের সফল প্রচেষ্টায় আমার আর তন্দ্রার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করানো হয় তখন জীবনে প্রথমবারের মতো আমি একটা বড় সর ধাক্কা খেয়েছিলাম। রাতে একা একা কথা বলতাম, হাসতাম, কাদঁতাম... একসময় ঘুমিয়ে পরতাম... মাকে তখন খুব ভয় পেতাম তাই জোড়ে কান্না করতে পারতাম না।বালিসে মুখ গুজে নিশ্বাস বন্ধ করে নিঃশব্দে কান্না করার ক্ষুদ্র অপচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলাম অনেকদিন ধরে... আমার বাক্সটার নিচের দিকে একটা ফাইল আছে। ফাইলে আমি তন্দ্রার মতো দেখতে মানুষের ছবির পেপার কাটিং রাখতাম। ওখানে ছেলেদেরও কিছু ছবি আছে। একদিন পেপারে দেখলাম একটা মেয়ের ছবি দিয়েছে। দুই বোনের ছবি। বড় বোন বসে আছে হাস্যজ্জ্বল মুখে , আর তার পাশে ছোট বোন দাড়িয়ে আছে। বড় বোনকে দেখে আমার চোখ পেপারে আটকিয়ে গেয়েছিল। পাশের ক্যাপশনে লেখা ছিল, 'মিথিলা বাচতে চায় '। পেপারটা সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম আমার ড্রয়ারে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পরলে ড্রয়ার থেকে বের করে বালিশের তলায় গুঁজে রাখতাম। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তা বের করে মোবাইলের হলুদ আলোতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একসময় লেখা গুলো ঝাপসা হয়ে আসতো। ঝাপসা লেখা গুলোকে মনে হতো 'তন্দ্রা বাঁচতে চায় ' আর মনে হতো ক্যান্সারটা ঠিক মিথিলার নয় ক্যান্সারটা হয়েছে তন্দ্রার...
পেপারে মেয়েটার বাবার নাম্বার দেওয়া ছিল। আমি প্রায়শই ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম মিথিলার কি খবর? উনি কখনো বলতেন ভালো, আর কখনো ক্লান্ত স্বরেই বলতেন ভালো। আমি কখনোই উনাকে সাহায্য করতে পারিনি, উল্টো মাঝে মাঝে ফোন করে বিরক্তই করতাম বলে মনে হয়। কিন্তু আমি একটা অসম্ভব টান অনুভব করতাম। তাই যেদিন থেকে শুনলাম অবস্থা অবনতির দিকে, আমি ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।কারণ আমি বিশ্বাস করি সে আজও বেচেঁ আছে। আমি বিশ্বাস করি, ভগবান তার সবকিছু কেড়ে নিলেও তার হাসিটুকু কেড়ে নিতে পারেনি। সেই ক্ষমতা ভগবানের নেই বলেই আমার বিশ্বাস। আমি আজও যখন তার হাস্যজ্জ্বল ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকি আমার ভগবানের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। আমার ঘৃণা জন্মায় ধর্মের প্রতি। আর আমার ঘৃণা জন্মায় নিজের প্রতি।
আমি তন্দ্রাকে কিছুই দিতে পারিনি, শুধু একদিন রাস্তায় সকলের সামনে একটা থাপ্পড় ছাড়া। সে আমাকে তবু ছেড়ে যায়নি তখন, ধরে রেখে ছিল বাচ্চাদের মতো। আমার কাছ থেকে একটা চিঠি পাবার আশায় প্রতি রাতে বায়না ধরতো। তবুও আমি লিখবো লিখবো করে মাস কাটিয়ে দিতাম। তার পাঠানো বেশিরভাগ চিঠির একটা অংশের লেখা অস্পষ্ট থাকতো। কলমের কালি ছাপিয়ে বুঝতে পারতাম সেগুলো ছিল তার কান্না মিশ্রিত লেখা। আমি তবুও লিখতাম না ... কারণ আমি জানতাম বাচ্চাদের সব আবদার মিটাতে নেই বা জানতাম সে আমাকে ছেড়ে কখনোই যেতে পারবে না। আজ হয়তোবা সে আর বাচ্চা নেই, তার বয়স হয়েছে ২৪ আর আমার ২২। ৬ বছর পর এসে মনে হচ্ছে সে আসলেই আমার থেকে ২ বছরের বড় ছিল, যে বিষয়টা কখনোই আমার মাথায় কাজ করতো না।আমি তাকে প্রায়শই বলতাম, "বিয়ার পর তোরে আমি মুসলমান বানায়া নাম দিমু হাজেরা খাতুন, বা জরিনা বেগম। " সে কিছু না বলে ফিক করে হেসে দিত। অই ভেবলা মার্কা হাসির শব্দ হয়তোবা আমি আর কখনোই শুনতে পারবো না। পারবো না কারণ তা শুনতে গেলে হয়তোবা তোমাদের জাত চলে যাবে। সমাজের লোকেরা ছি ছি করবে। তোমার ছোট বোনের আর হয়তোবা বিয়ে হবে না। তোমার বাবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হয়তো ধুলোয় মিশে যাবে। তার বদলে একজন সাব্বির আহমেদ বা তন্দ্রা বকসীর ফকিরা ভালোবাসা -বাসির কোরবানি দেওয়াই উওম। যা হয়তো তন্দ্রা বকসী মুখ বুজে মেনে নিলেও আমি হয়তোবা মেনে নিব না।
আমি হলাম হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মতো। হোমিওপ্যাথি ঔষুধ যে এলাপ্যাথিক ঔষুধের বিপরীত নীতিতে কাজ করে তা কি জানা আছে তোমার? ধরো একটা এন্টিবায়োটিক ঔষুধ ভেঙ্গে যদি আমরা অর্ধেকটা খাই তাহলে তার কার্যকারীতা আমরা অর্ধেকই পাবো, কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে তা হচ্ছে উল্টো। হোমিওপ্যাথিতে ঔষুধ যত বেশীবার তরলীকরণ করা হবে, ওই ডোজের পাওয়ার ততো বেশী হবে। হোমিওপ্যাথির অন্যতম উপকরণ হচ্ছে তুঝা। এক চিমটি উপকরণ নিয়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরি করা হয়; বারবার জলে বা স্পিরিটে দ্রবীভূত করে ঝাঁকিয়ে, তার থেকে দশভাগ নিয়ে আবার সেটাকে আরও তরল করে তারপর আবার…আবারও…এভাবে আরও দশবার, বিশবার করার পর যদি প্রথম পাত্রের পাওয়ারে জ্বরের মতো ছুটকা ফুটকা অসুখ ভালো হয় তাহলে সর্বশেষ পাত্রের ঔষুধ দিয়ে যক্ষার রোগ সারবে। আদৌ শেষ পাত্রে কোনো উপকরণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুজে পাওয়া যাবে কিনা তাতে অবশ্য আমার সন্দেহ আছে। যাইহোক শেষ বয়সে আমার হোমিওপ্যাথির দোকান দেওয়ার একটা ইচ্ছা অবশ্য আছে। নাম দিব 'তন্দ্রা হোমিওপ্যাথিক ঔষুধালয় ' এর নিচে লেখা থাকবে 'ড. সাব্বির আহমেদ ', আর তার নিচে লেখা থাকবে 'রোগী দেখার সময় : সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা, শুক্র -শনি বন্ধ'। শুধু রোগীদের দেখলেই তো চলবে না, নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও তো খেয়াল রাখা দরকার। তাই শুক্র শনি বন্ধ। তো যা বলছিলাম, আমি হচ্ছি হোমিওপ্যাথিক ঔষুধের মতো। যতদিন যাচ্ছে তন্দ্রাহারা হয়ে যাচ্ছি। অবশ্য সবাই ভাবছে আমি স্বাভাবিকই আছি। আমার নিজেরও বেশিরভাগ সময় তা ই মনে হয়, আমি স্বাভাবিকই আছি। গত এক সপ্তাহ ধরে বোনের বাসায় আছি। একা থাকতে ভয় লাগে, তাই আছি আরকি। তাছাড়া প্রজেক্টের কাজ চলতেছে, জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১০ই ডিসেম্বর। বাসায় পিসি নাই, বোনের বাসার পিসিতে কাজ সারতেছি (তেছি, তেছ, গেছি, খাইলাম, দাইলাম টাইপের শব্দ ব্যাবহার করতেছি, যাতে মনের ভাব সঠিক ভাবে তোমার কাছে উপস্থাপন করবার পারি)। ১ তারিখে মানিকগঞ্জ যাইতে হবে প্রজেক্টের কাজে। ভাবছিলাম হাতের প্লাস্টার দেইক্ষা স্যারে কইবো, "থাক তোমার যাওয়ার দরকার নাই, গ্রুপের বাকি মেম্বারদের কে তোমার বিষয়টি বলে দেব। তারাই বাকিটা হ্যান্ডল করবে। ", ভাবছিলাম এই সুযোগে আমিও দেবদাস হউয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো। সমস্যা হইলো, স্যারেও এই ধরনের কথা বলে নাই, আর আমার ভিতরেও দেবদাসের কোন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। অনেক চেষ্টা করি মন খারাপ করে থাকার, তারপরও কিচ্ছু হচ্ছে না বাড়া। আমার এক বন্ধু আছে রিজভী যে তার স্বভাবসুলভ ফাইজলামির সুরে আমাকে কইলো সেদিন, "বাড়া, তোকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না মা কালী তোর পাছায় ছ্যাঁকা দিয়েছে! একটু কান্নাকাটি কর বাড়া, পার্টি -সার্টি দে। গোলাপজলের আয়োজন করবি, তা না দাড়ি গোফ শান করে বসে আছিস।" আমি আসলেই স্বাভাবিক থাকি বেশিরভাগ সময়েই, ততক্ষণই যতক্ষণ কেউ না কেউ আমার পাশে থাকে। যখন ঘুমাতে যাই তখনই শুধু খুব খারাপ লাগে, ভিতরে একটা চাপ অনুভব করি। ঘুম আসতে চায় না, গলা ছেড়ে হেড়ে গলায় কাদতেঁ ইচ্ছে হয়, তাও পারি না। একসময় ঘুমিয়ে পরি ... ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিটা সকালে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে আতঙ্কের সাথে। ধর মর করে উঠে বসতাম, বুক ধর ফর করতো খুব। বুঝতাম দুঃস্বপ্ন কারণে এই উঠে বসা, কিন্তু উঠার পর কি দেখেছিলাম তা মনে করতে পারতাম না। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ করে মনে পরত, সাথে সাথেই শর্টনোট করে রাখতাম। গত দুইদিন ধরে তা আর হচ্ছে না, কারণ রাতে আর ঘুমাই না। ৫ টার দিকে ঘুমাতে যাই, আর উঠি বোনের চিল্লাচিল্লির আওয়াজে... জামাইয়ের সাথে নিত্যদিনের চিল্লাচিল্লি। তখন মনে হয়, না শালা ভালোই আছি। এই তন্দ্রা ছন্দ্রা চাঙ্গে উঠাইয়া নতুন উদ্দ্যমে যেগে উঠি। কিন্তু আমি জানি তা আমার দ্বারা সম্ভব না। এটা আমি যেমন জানি, তোমার দিদিও ঠিক তা ই জানে। ও প্রায়শই বলতো, "তোমার গুদ্দাটা অনেক বড়"। আমি বলেছিলাম গুদ্দা কি? ও বলল মানুষের যেই জায়গায় নাকি সাহস থাকে অই জায়গাটার নাম 'গুদ্দা '। (আমি কিন্তু ভাবছিলাম অশ্লীল কিছু)। সাহসের কথা বললে বলতে হবে আমার গুদ্দা আসলেই অনেক বড়। তা যে ঠিক কত বড়, তা হয়তোবা তুমি একদিন দেখতে পারবা । এখন দেখা যাক এই গুদ্দার কাজ ভালো কিছুতে লাগাতে পারি কিনা।
- ইতি বড় গুদ্দাওলা একজন ব্যর্থ প্রেমিক পুরুষ। (প্রেমিক পুরুষ লেখার পর মনে পড়ল, সাকিব খানের এই নামে একটা ছবি আছে। ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী। অপু বিশ্বাস আর রুমানা আছে। সময় পাইলে দেখবা কিন্তু।)
বদনারও যে নাম থাকে তা আগে কখনো লক্ষ্য করি নাই। আজকে করলাম। বোনের বাসায় দুইটা বাথরুম আছে। একটায় বদনা আছে, আরেকটায় নাই। যেটায় আছে ঐটার বদনার নাম হইলো গিয়া 'রাজা '!! বিশ্বাস হচ্ছে না? না হউয়ারই কথা। 'সাগর ' নামে কোন বদনা থাকলে সেটা আমার কাছে অবিশ্বাস্যই ঠেকাবে। যাই হোক আমি তোমাকে ঐ ভাঙ্গা বদনার ছবি তুলে পাঠাবো। হয়তোবা এতে তোমার কিছু যায় আসবে না, কিন্তু আমার আসবে। আমি অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও মাথা ঘামাই, অযথাই। একটা সময় ছিল যখন একটা মেয়ের পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়া ধুলোও সংরক্ষণ করার জন্য মন আঁকুপাঁকু করতো। ওই সময়ের ওই দিনগুলোতে ওই মেয়েটির থেকে পাওয়া বা কুড়িয়ে নেওয়া কিছু জিনিসের ফিরিস্তি দিলে তুমি হয়তোবা কিছুটা আচঁ করতে পারবা। আমার একটা বাক্স আছে, ঐটাতে আমি ঐ মেয়েটার থেকে পাওয়া (বিশেষ করে ব্যাবহার করে ফেলে দেওয়ার মতো জিনিসপত্র) জিনিসপত্র রাখি। বিভিন্ন বদনার মতো আমার অই বাক্সটারও একটা নাম আছে, 'তন্দ্রা বিলাস '। ঐ বাক্সটায় ভাঙ্গা চুলের ক্লিপ থেকে শুরু করে হাতের নখ পর্যন্ত আছে। ঐ মেয়েটার খেয়ে বেচেঁ যাওয়া পপকর্ণ সুন্দর করে প্যাকেট করা আছে। গত চারবছরে পপকর্ণ গুলো একেবারে চিপসে কালচে দাগ পরে গেছে। একটা টুরিস্ট চকলেটের খালি প্যাকেট টিস্যু দিয়ে পেচিয়ে রাখা আছে। একবার সে আমাকে পেভিসন ঔষুধ কিনে দিয়েছিল। সেটা আমি ব্যাবহার না করে রেখে দিয়েছিলাম বাক্সটিতে। আমার ওয়ারিদ নাম্বারটা ও কিনে দিয়েছিল, অই প্যাকেটাও আছে ওখানে। একটা আংটির ছোট বাক্স আছে ওখানে। ওটাতে আংটি না থাকলেও একটা ভাঙ্গা মাথার ক্লিপ, একটা ক্লোরমিন্টের খালি প্যাকেট, একটা দলা মোচড় হয়ে যাওয়া টিস্যু, একটা চুল, আর একটা আধ খাওয়া সিগেরেটের টুকরো আছে। সিগেরেট টা সে আমার জন্মদিন উপলক্ষে খেয়েছিল। একটা প্যাকেটে ২৩ টা স্ট্র রাখা আছে যা দিয়ে সে একসময় কোল্ডড্রিংস্ক খেয়েছিল। একদিনে না অনেক দিন লাগিয়ে খেয়ে থাকা স্ট্র...আর আছে অনেক কাগজে বানানো নৌকা, বাক্স আর রং বেরঙ্গের প্লেন...আরো অনেক কিছুই আছে যা তোমাদের ভাষায় হয়তো অর্থহীন ছাগলামি, কিন্তু কারো কারো কাছে ওগুলোর আলাদা একটা অর্থ আছে। যে অর্থ হয়তো একটা টোকাইকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের পরিত্যক্ত জিনিস খুজে পাওয়ার আনন্দ দিয়ে থাকে। যে আনন্দের সিকি ভাগও হয়তোবা তোমরা কখনো বুঝতে পারবা না।
৫ বছর আগে যখন তোমাদের আর আমাদের পরিবারের সফল প্রচেষ্টায় আমার আর তন্দ্রার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করানো হয় তখন জীবনে প্রথমবারের মতো আমি একটা বড় সর ধাক্কা খেয়েছিলাম। রাতে একা একা কথা বলতাম, হাসতাম, কাদঁতাম... একসময় ঘুমিয়ে পরতাম... মাকে তখন খুব ভয় পেতাম তাই জোড়ে কান্না করতে পারতাম না।বালিসে মুখ গুজে নিশ্বাস বন্ধ করে নিঃশব্দে কান্না করার ক্ষুদ্র অপচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলাম অনেকদিন ধরে... আমার বাক্সটার নিচের দিকে একটা ফাইল আছে। ফাইলে আমি তন্দ্রার মতো দেখতে মানুষের ছবির পেপার কাটিং রাখতাম। ওখানে ছেলেদেরও কিছু ছবি আছে। একদিন পেপারে দেখলাম একটা মেয়ের ছবি দিয়েছে। দুই বোনের ছবি। বড় বোন বসে আছে হাস্যজ্জ্বল মুখে , আর তার পাশে ছোট বোন দাড়িয়ে আছে। বড় বোনকে দেখে আমার চোখ পেপারে আটকিয়ে গেয়েছিল। পাশের ক্যাপশনে লেখা ছিল, 'মিথিলা বাচতে চায় '। পেপারটা সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম আমার ড্রয়ারে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পরলে ড্রয়ার থেকে বের করে বালিশের তলায় গুঁজে রাখতাম। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তা বের করে মোবাইলের হলুদ আলোতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একসময় লেখা গুলো ঝাপসা হয়ে আসতো। ঝাপসা লেখা গুলোকে মনে হতো 'তন্দ্রা বাঁচতে চায় ' আর মনে হতো ক্যান্সারটা ঠিক মিথিলার নয় ক্যান্সারটা হয়েছে তন্দ্রার...
পেপারে মেয়েটার বাবার নাম্বার দেওয়া ছিল। আমি প্রায়শই ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম মিথিলার কি খবর? উনি কখনো বলতেন ভালো, আর কখনো ক্লান্ত স্বরেই বলতেন ভালো। আমি কখনোই উনাকে সাহায্য করতে পারিনি, উল্টো মাঝে মাঝে ফোন করে বিরক্তই করতাম বলে মনে হয়। কিন্তু আমি একটা অসম্ভব টান অনুভব করতাম। তাই যেদিন থেকে শুনলাম অবস্থা অবনতির দিকে, আমি ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।কারণ আমি বিশ্বাস করি সে আজও বেচেঁ আছে। আমি বিশ্বাস করি, ভগবান তার সবকিছু কেড়ে নিলেও তার হাসিটুকু কেড়ে নিতে পারেনি। সেই ক্ষমতা ভগবানের নেই বলেই আমার বিশ্বাস। আমি আজও যখন তার হাস্যজ্জ্বল ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকি আমার ভগবানের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। আমার ঘৃণা জন্মায় ধর্মের প্রতি। আর আমার ঘৃণা জন্মায় নিজের প্রতি।
আমি তন্দ্রাকে কিছুই দিতে পারিনি, শুধু একদিন রাস্তায় সকলের সামনে একটা থাপ্পড় ছাড়া। সে আমাকে তবু ছেড়ে যায়নি তখন, ধরে রেখে ছিল বাচ্চাদের মতো। আমার কাছ থেকে একটা চিঠি পাবার আশায় প্রতি রাতে বায়না ধরতো। তবুও আমি লিখবো লিখবো করে মাস কাটিয়ে দিতাম। তার পাঠানো বেশিরভাগ চিঠির একটা অংশের লেখা অস্পষ্ট থাকতো। কলমের কালি ছাপিয়ে বুঝতে পারতাম সেগুলো ছিল তার কান্না মিশ্রিত লেখা। আমি তবুও লিখতাম না ... কারণ আমি জানতাম বাচ্চাদের সব আবদার মিটাতে নেই বা জানতাম সে আমাকে ছেড়ে কখনোই যেতে পারবে না। আজ হয়তোবা সে আর বাচ্চা নেই, তার বয়স হয়েছে ২৪ আর আমার ২২। ৬ বছর পর এসে মনে হচ্ছে সে আসলেই আমার থেকে ২ বছরের বড় ছিল, যে বিষয়টা কখনোই আমার মাথায় কাজ করতো না।আমি তাকে প্রায়শই বলতাম, "বিয়ার পর তোরে আমি মুসলমান বানায়া নাম দিমু হাজেরা খাতুন, বা জরিনা বেগম। " সে কিছু না বলে ফিক করে হেসে দিত। অই ভেবলা মার্কা হাসির শব্দ হয়তোবা আমি আর কখনোই শুনতে পারবো না। পারবো না কারণ তা শুনতে গেলে হয়তোবা তোমাদের জাত চলে যাবে। সমাজের লোকেরা ছি ছি করবে। তোমার ছোট বোনের আর হয়তোবা বিয়ে হবে না। তোমার বাবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হয়তো ধুলোয় মিশে যাবে। তার বদলে একজন সাব্বির আহমেদ বা তন্দ্রা বকসীর ফকিরা ভালোবাসা -বাসির কোরবানি দেওয়াই উওম। যা হয়তো তন্দ্রা বকসী মুখ বুজে মেনে নিলেও আমি হয়তোবা মেনে নিব না।
আমি হলাম হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মতো। হোমিওপ্যাথি ঔষুধ যে এলাপ্যাথিক ঔষুধের বিপরীত নীতিতে কাজ করে তা কি জানা আছে তোমার? ধরো একটা এন্টিবায়োটিক ঔষুধ ভেঙ্গে যদি আমরা অর্ধেকটা খাই তাহলে তার কার্যকারীতা আমরা অর্ধেকই পাবো, কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে তা হচ্ছে উল্টো। হোমিওপ্যাথিতে ঔষুধ যত বেশীবার তরলীকরণ করা হবে, ওই ডোজের পাওয়ার ততো বেশী হবে। হোমিওপ্যাথির অন্যতম উপকরণ হচ্ছে তুঝা। এক চিমটি উপকরণ নিয়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরি করা হয়; বারবার জলে বা স্পিরিটে দ্রবীভূত করে ঝাঁকিয়ে, তার থেকে দশভাগ নিয়ে আবার সেটাকে আরও তরল করে তারপর আবার…আবারও…এভাবে আরও দশবার, বিশবার করার পর যদি প্রথম পাত্রের পাওয়ারে জ্বরের মতো ছুটকা ফুটকা অসুখ ভালো হয় তাহলে সর্বশেষ পাত্রের ঔষুধ দিয়ে যক্ষার রোগ সারবে। আদৌ শেষ পাত্রে কোনো উপকরণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুজে পাওয়া যাবে কিনা তাতে অবশ্য আমার সন্দেহ আছে। যাইহোক শেষ বয়সে আমার হোমিওপ্যাথির দোকান দেওয়ার একটা ইচ্ছা অবশ্য আছে। নাম দিব 'তন্দ্রা হোমিওপ্যাথিক ঔষুধালয় ' এর নিচে লেখা থাকবে 'ড. সাব্বির আহমেদ ', আর তার নিচে লেখা থাকবে 'রোগী দেখার সময় : সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা, শুক্র -শনি বন্ধ'। শুধু রোগীদের দেখলেই তো চলবে না, নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও তো খেয়াল রাখা দরকার। তাই শুক্র শনি বন্ধ। তো যা বলছিলাম, আমি হচ্ছি হোমিওপ্যাথিক ঔষুধের মতো। যতদিন যাচ্ছে তন্দ্রাহারা হয়ে যাচ্ছি। অবশ্য সবাই ভাবছে আমি স্বাভাবিকই আছি। আমার নিজেরও বেশিরভাগ সময় তা ই মনে হয়, আমি স্বাভাবিকই আছি। গত এক সপ্তাহ ধরে বোনের বাসায় আছি। একা থাকতে ভয় লাগে, তাই আছি আরকি। তাছাড়া প্রজেক্টের কাজ চলতেছে, জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১০ই ডিসেম্বর। বাসায় পিসি নাই, বোনের বাসার পিসিতে কাজ সারতেছি (তেছি, তেছ, গেছি, খাইলাম, দাইলাম টাইপের শব্দ ব্যাবহার করতেছি, যাতে মনের ভাব সঠিক ভাবে তোমার কাছে উপস্থাপন করবার পারি)। ১ তারিখে মানিকগঞ্জ যাইতে হবে প্রজেক্টের কাজে। ভাবছিলাম হাতের প্লাস্টার দেইক্ষা স্যারে কইবো, "থাক তোমার যাওয়ার দরকার নাই, গ্রুপের বাকি মেম্বারদের কে তোমার বিষয়টি বলে দেব। তারাই বাকিটা হ্যান্ডল করবে। ", ভাবছিলাম এই সুযোগে আমিও দেবদাস হউয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো। সমস্যা হইলো, স্যারেও এই ধরনের কথা বলে নাই, আর আমার ভিতরেও দেবদাসের কোন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। অনেক চেষ্টা করি মন খারাপ করে থাকার, তারপরও কিচ্ছু হচ্ছে না বাড়া। আমার এক বন্ধু আছে রিজভী যে তার স্বভাবসুলভ ফাইজলামির সুরে আমাকে কইলো সেদিন, "বাড়া, তোকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না মা কালী তোর পাছায় ছ্যাঁকা দিয়েছে! একটু কান্নাকাটি কর বাড়া, পার্টি -সার্টি দে। গোলাপজলের আয়োজন করবি, তা না দাড়ি গোফ শান করে বসে আছিস।" আমি আসলেই স্বাভাবিক থাকি বেশিরভাগ সময়েই, ততক্ষণই যতক্ষণ কেউ না কেউ আমার পাশে থাকে। যখন ঘুমাতে যাই তখনই শুধু খুব খারাপ লাগে, ভিতরে একটা চাপ অনুভব করি। ঘুম আসতে চায় না, গলা ছেড়ে হেড়ে গলায় কাদতেঁ ইচ্ছে হয়, তাও পারি না। একসময় ঘুমিয়ে পরি ... ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিটা সকালে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে আতঙ্কের সাথে। ধর মর করে উঠে বসতাম, বুক ধর ফর করতো খুব। বুঝতাম দুঃস্বপ্ন কারণে এই উঠে বসা, কিন্তু উঠার পর কি দেখেছিলাম তা মনে করতে পারতাম না। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ করে মনে পরত, সাথে সাথেই শর্টনোট করে রাখতাম। গত দুইদিন ধরে তা আর হচ্ছে না, কারণ রাতে আর ঘুমাই না। ৫ টার দিকে ঘুমাতে যাই, আর উঠি বোনের চিল্লাচিল্লির আওয়াজে... জামাইয়ের সাথে নিত্যদিনের চিল্লাচিল্লি। তখন মনে হয়, না শালা ভালোই আছি। এই তন্দ্রা ছন্দ্রা চাঙ্গে উঠাইয়া নতুন উদ্দ্যমে যেগে উঠি। কিন্তু আমি জানি তা আমার দ্বারা সম্ভব না। এটা আমি যেমন জানি, তোমার দিদিও ঠিক তা ই জানে। ও প্রায়শই বলতো, "তোমার গুদ্দাটা অনেক বড়"। আমি বলেছিলাম গুদ্দা কি? ও বলল মানুষের যেই জায়গায় নাকি সাহস থাকে অই জায়গাটার নাম 'গুদ্দা '। (আমি কিন্তু ভাবছিলাম অশ্লীল কিছু)। সাহসের কথা বললে বলতে হবে আমার গুদ্দা আসলেই অনেক বড়। তা যে ঠিক কত বড়, তা হয়তোবা তুমি একদিন দেখতে পারবা । এখন দেখা যাক এই গুদ্দার কাজ ভালো কিছুতে লাগাতে পারি কিনা।
- ইতি বড় গুদ্দাওলা একজন ব্যর্থ প্রেমিক পুরুষ। (প্রেমিক পুরুষ লেখার পর মনে পড়ল, সাকিব খানের এই নামে একটা ছবি আছে। ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী। অপু বিশ্বাস আর রুমানা আছে। সময় পাইলে দেখবা কিন্তু।)
0 comments:
Post a Comment