Friday, August 2, 2013

একটি অসম্পূর্ণ স্মৃতি...

গত বছরের ১২.১২.১২ তে আমি ভার্সিটির শেষ ক্লাসটি করেছিলাম। ক্লাস শেষে কেন জানি ইচ্ছে হল হেঁটে হেঁটে বাসায় আসার। ভার্সিটি থেকে বাসা আবার বেশ খানিকটা দূরত্ব, প্রায় ৫ কিলোমিটার হবে। অনেকদূরই বলা চলে, তবে আজ যেহেতু আমার শেষ ক্লাস তাই হেঁটে হেঁটে আসার সময় ভার্সিটির স্মৃতিগুলোই মনে করা উচিত। তাই আমিও শুরু করেছিলাম হাটা। কিন্তু আপনি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, আর তা হচ্ছে আপনি যখন যা প্ল্যান করে চিন্তা করতে চাইবেন, তা কখনোই আপনার মাথায় আসবে না। আমারও আসেনি, প্রতিদিনের মতোই হাজার হাজার চিন্তা মাথায় আসছিল, তবে সেগুলোর মধ্যে একটিও ভার্সিটি রিলেটেড না। সব চিন্তা-ভাবনা ছাপিয়ে কেন জানি আমার প্রথমদিনে স্কুলের কথাই মাথায় আসছিল বার বার...

আমার আপনাদের মতো কোন বন্ধু বান্ধব নেই। ভার্সিটির পুরো চারটি বছর আমি একা একা ঘুড়েছি. ভার্সিটির কোনায় কোনায় একা একা বসে থেকেছি, একা একা ক্লাস করেছি। বাসাতেও এসেছি প্রতিটাদিন একা একা... যদিও বিকেলে ক্লাস শেষে বাসায় ফিরার সময় দেখতাম আমার সাথে হাজার হাজার মানুষ ব্যাস্ত হয়ে হাঁটছে বা ঘাড় ফিরিয়ে দেখতাম বাসের জন্য অপেক্ষারত মানুষদেরকে। আমি তাদের দেখে বুঝতাম তারা শুধু অপেক্ষাই করছে না, শঙ্কিত হয়ে ভাবছে আদো তারা তাদের কাঙ্গিত বাসটিতে উঠতে পারবে কি না! মাঝে মাঝে আমিও তাদের ভীড়ে অপেক্ষা করতাম।  বাসে উঠার সময় অপেক্ষারত ক্লান্ত শ্রান্ত দেহের মানুষগুলো আমার মতো তরতাজা কুঁড়ের সাথে পেরে উঠতো না। বাসে উঠার পর জানলার গ্লাস গেলে দেখতাম সেইসব হেরে যাওয়া মানুষদের মুখগুলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম, বাসে উঠতে না পারা মানুষগুলোর বেশীরভাগ হাসছে! এই হাসির একটা আলাদা নাম আছে আমার কাছে, আর সেটা হচ্ছে ‘ভ্যাবদামার্কা হাসি’। এই ‘ভ্যাবদামার্কা হাসিতে’ দুঃখবোধ যেরকম থাকে, সেরকম থাকে পরিহাস। নিজের প্রতি, দেশের প্রতি, রাস্তার প্রতি, ৬ নম্বার বাসের প্রতি এই পরিহাস মিশ্রিত থাকে। আমিও হাসি এই ধরণের ভ্যাবদামার্কা হাসি, যখন দেখতাম ভার্সিটিতে হালকা পাতলা পরিচিত কোনো মুখ গ্রুপ বেঁধে আড্ডা দিতে দিতে আমাকে দেখে ডাক দেয় হাত বাড়িয়ে। আমি তখন সেই ‘ভ্যাবদামার্কা হাসি’ হাসতে হাসতে এগিয়ে যেতাম তাদের দিকে। তবে তখন সেই ভ্যবদামার্কা হাসিতে পরিহাস মিশ্রিত থাকতো না। যেটা মিশ্রিত থাকতো সেটা হচ্ছে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রস্তুতজনিত সমস্যা’. আমার ধারণা এই ধরণের পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকেই কম বেশী পরতে হয়েছে। ধরুন আপনি পকেটে দশটাকা নিয়ে ঘুরছেন, কিভাবে কি করবেন তা নিয়ে ভাবছেন। ঠিক সে সময় যদি কোনো ফকির আপনার কাছে এসে ভিক্ষা চায়, আপনি তখন সেই ভ্যাবলামার্কা হাসিটি দিয়ে মাথা নাড়বেন। এটাই হচ্ছে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রস্তুতজনিত সমস্যা’. আর সেই হালকা পরিচিত আড্ডায় মগ্ন মানুষটি যখন কোল্ড ড্রিংস আর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমাকে অনুরোধ করতো খাওয়ার জন্য, আমি তখন সেই হাসিটি দিয়ে বলতাম “একটু আগেই খেলাম মাত্র...!!”. এটাই হচ্ছে আমার জন্য ‘অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রস্তুতজনিত ভ্যাবদামার্কা হাসি'।

আপনাকে আরেকটি জিনিস বলি, আর সেটা হচ্ছে যখন দেখবেন আপনার পকেটে টাকা নাই তখন রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় রাস্তার দু’পাশে যা ই দেখবেন সবই আপনার খেতে ইচ্ছে করবে। হাঁটছেন, দেখলেন সিঙ্গারা বানাচ্ছে... খেতে ইচ্ছে করবে। হাঁটছেন, দেখলেন জিলাপি বিক্রি করছে... খেতে ইচ্ছে করবে। হাঁটছেন, দেখলেন আস্ত তরমুজ বিক্রি করছে... তা ও খেতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু দেখা যাবে আপনি হয়তো ব্যাক্তিগতভাবে তরমুজও পছন্দ করেন না আবার জিলাপিও না। আমিও এসব পছন্দ করি না। তাই আমি কিনতাম ৫ টাকার বাদাম। বাদামের নাকি অনেক পুষ্টিগুণ। বাদামে রয়েছে ‘চর্বি ও প্রোটিন’, তবে খুব বেশী ভিটামিন নেই এতে। তবে পটাশিয়াম রয়েছে প্রচুর। জেনে রাখা ভালো, ১.৫ আউন্স বাদামে রয়েছে ২৪৯ গ্রাম ক্যালোরী, ২১.১ গ্রাম ফ্যাট এবং ১০.১ গ্রাম প্রোটিন। বাদামে এতোকিছু থাকতে সিঙ্গারা বা জিলাপি আমি কেন খাব বলুন তো ?

শেষ যেদিন বাসায় ফিরছিলাম ভার্সিটি থেকে, সেদিনও বাদামওলা খুজতেছিলাম মূল ফটক হতে বের হয়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, সেদিন আমি একটি বাদামওলাও দেখতে পায়নি। এটা যদি কোনো মুভির দৃশ্য হতো তাহলে হয়তো দেখা যেত মূল চরিত্র ভার্সিটির সামনে থেকে বাদাম কিনে বৃষ্টির মধ্যে সে আর তার প্রিয়তমা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে অথবা এটা যদি আমার গল্প না হয়ে আপনার গল্প হতো তাহলেও  হয়তো দেখা যেত মূল চরিত্রকে ঘিরে তার বন্ধু-বান্দবরা মূল ফটক থেকে হৈ হোল্লব করে বের হয়ে বাদাম কিনে খাচ্ছে। এক একটা বাদাম মুখে দেওয়ার পর বাদামের খোসা একজন আরেকজনের গায়ে ছুড়ে মারছে। যার গায়ে ছুড়ে মারছে, সে কট মট করে তাকিয়ে তার বন্ধু কে দৌড়ানি দিচ্ছে... আমার সাথে শেষদিন এসবের কিছুই হয়নি। আমি সেদিন বৃষ্টিতে প্রিয়তমার হাত ধরেও হাটতে চায়নি, বন্ধুদের সাথে হৈ হোল্লড় করেও শেষ দিনটি উদযাপন করতে চায়নি, আমি চেয়েছিলাম  সামান্য ৫ টাকার বাদাম খেতে খেতে বাসায় হেঁটে আসার জন্য...

একা একা মনে মনে বাদাম চিবুতে চিবুতে ভাবছিলাম আমার প্রথম স্কুলে ভর্তি হউয়ার দিনটির কথা, ১৯৯৫ সালের কথা। আমার বাবা রাঙ্গামাটিতে বদলি হয়। পাহাড়ের উপর বাসা, উপরে টিনশেড আর পাশে দেয়াল, সামনে পিছনে অনেক জায়গা। আমার বয়স তখন ৫ বছর, সারাদিন বাসার বাউন্ডারিতে ছোটাছুটি করি। এই টাংকির উপর উঠি তো, এই পেয়ারা গাছে।  তবে ছোটাছুটি বন্ধ নেই। তবে আমি বেশীরভাগ সময় পিপড়া নিয়েই খেলতাম। রাঙ্গামাটিতে আবার অনেক ধরণের পিপড়া আছে। এক ধরণের পিপড়া আছে যার হুলে খানিকটা বিষ থাকে। গায়ে উঠা মাত্র হুল ফুটিয়ে দেয়। যার বিষে মারাত্মক ক্ষতি না হলেও অনেকখানি জায়গা ফুলে যায় আর অনেকক্ষণ ধরে জ্বলা ধরে থাকে। আবার আরেক ধরণের পিপড়া আছে যেটা সব জায়গাতেই দেখা যায়। মাথাটা মোটা, দুটা দাত থাকে আর মাথার দু'পাশে থাকে দুটি বড় বড় চোখ। আমার এই বড় বড় চোখওলা পিপড়া গুলোই ভালো লাগতো বেশ। তাই ম্যাচ বক্সে করে চার পাচটা পিপড়া নিয়ে ঘুরতাম সারাক্ষণ। বাসার সামনে কালবৌশাখী ঝড়ে হেলে পরা জাম গাছেটির ডালে হেলান দিয়ে পিপড়া নিয়ে খেলতাম বেশীরভাগ সময়। দুই হাতে থাকতো বড় বড় দুইটি পিপড়া, একটাকে দিয়ে আরেকটাকে কামড় দেওয়াতাম। তখন জানতাম না যে প্রাচিন রোমের এরিনাতে গ্লাডিয়টরটা একে অপরকে ঘায়েল করতো যেকোনো একজনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আর সেইসব লড়াই প্রাণভরে উপভোগ করতো রোমের শাসকেরা। ছোটবেলায় এই বিষয়টি আমার না জানা থাকলেও ‘পিপড়া’ গুলো নিয়ে আমি এভাবেই খেলতাম। আবার বাবার ড্রয়ার থেকে চুরি করা আতস কাঁচ দিয়ে রোদের তীব্র আলো দিয়ে মেরে মজা পেতাম হুলওলা পিপড়াগুলোকে। এভাবে মেরে ফেলতাম দেখে আবার ভেবে বসবেন না যে আমি অনেক নিষ্ঠুর। ‘পিপড়া’ আমি কখনোই ঘৃণা করতাম না, কারণ সেই সময়ের দিনগুলোতে এগুলাই ছিল আমার খেলার একমাত্র উপকরণ বা আমার খেলার সাথী বা আমার পরম বন্ধু। যদিও তখনো ‘বন্ধু মানে কি?’ তা আমার জানা ছিল না, তারপরও কেউ যদি তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করত ‘কিছু বন্ধুর নাম বলার জন্য’, আমি হয়তো কারো নাম বলতে পারতাম না ঠিকই তবে আঙ্গুল উচিয়ে নিশ্চয়ই পিপড়াগুলোকেই দেখাতাম...

একদিন শুনলাম আমি স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছি। সরাসরি ক্লাস ওয়ানে, কারণ রাঙ্গামাটিতে নার্সারী, কেজি টাইপের স্কুল অনেক দূরে। আর আমরা থাকতাম পর্যটনের কাছাকাছি। তাই কাছের একটা স্কুলে ভর্তি হতে হবে, অল্প বয়সের আমাকে দূরে পাঠানো যাবে না। কাছাকাছির যে স্কুলটি ঠিক করা হলো, তা ও হচ্ছে বাসা থেকে ৩ কিলো দূরে। স্কুলের নাম 'দক্ষিণ বালিকা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় '। 'উচ্চ বিদ্যালয় 'লেখা থাকলেও স্কুল ছিল ক্লাস ৫ পর্যন্ত, আর 'বালিকা 'লেখা থাকলেও কিছু বালকেরাও পড়তো ওখানে।  আর আমি ছিলাম সেখানকারই গুটিকয়েক বালকের একজন।

প্রথম স্কুলে যাবার দিনের কথা এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে। নতুন স্কুল ড্রেস পরে আমি আর আমার বড় বোন আমাদের বাবার পিয়নের সাথে স্কুলের দিকে হেটে রওনা দিয়েছিলাম। রাঙ্গামাটিতে রিকশা চলে না তাই হেটে হেটেই যেতে হয়েছিল আমাদের। স্কুলে যাওয়ার পর আমাকে শূন্য একটি ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল আমাদের পিয়ন। একটু পর দেখলাম একটা ছেলে এসেছে। বসেছে ঠিক আমার পিছনের বেঞ্চে। একপর্যায়ে সে আমাকে তার নাম বলল। জানলাম প্রথম স্কুলের প্রথম ক্লাসে আমার সাথে প্রথম যে ছেলেটার পরিচয় হলো, তার নাম হচ্ছে 'মানিক '... নাম বলার পর সে আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল। তাই আমিও খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকলাম তাকে। দেখলাম মানিক এর গায়ে কোন স্কুল ড্রেস নেই, কোন ব্যাগও নিয়ে আসেনি সে। গায়ের শার্ট ময়লা, যার মাত্র ২ থেকে ৩ টা বোতামই আছে। তাই নিচের দিকে শার্ট দুইদিকে ছড়িয়ে তার পেটের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। তখন শীতকাল চলছিল কিনা মনে নেই কিন্তু মানিকের নাক দিয়ে যে 'হিঙ্গিস ' উকি দিচ্ছিল একটু পর পর তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। মানিক একসময় আমাকে প্রথম যে কথাটা বলেছিল তা হলো,

 'নতুন আইছো? '
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই, সে বলল "কলা আঁকতে পারোনি? "
আমি 'পারি না 'বলতেই সে বলল, "কৃষ্ণা দিদিমণি তাইলে তো তোমারে মাইরা ফাডাইলাইবো, আইজকা কৃষ্ণা দিদিমনির ক্লাস আছে"
আমি আর কোন প্রশ্নের অপেক্ষা না করে ভ্যা করে কেদে দিয়েছিলাম।

একা একা রাস্তা দিয়ে হাটার সময় ঐ দিনের ঘটনাটা মনে পড়ার পর নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি এসে পরেছিল... আর ঠিক সেই সময়টাতেই আমার চোখ থেকে দু তিন ফোটা করে জল গড়িয়ে পরতে থাকে গাল বেঁয়ে। যদিও আমি জানি আমি এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি, আমার ভার্সিটির শেষ ক্লাস করে এসেছি, আমার কান্না করাটা বেমানান... তারপরও কাঁদতে কেন জানি খুব ভালো লাগছিল... বাদামওলাকে খুজে না পেলেও আমি বাদাম খাচ্ছিলাম মনে মনে, বৃষ্টি না পরলেও বৃষ্টি পড়ছিল আমার গাল বেঁয়ে...

এনিমেশন-কথন ও তিনটি শর্টফিল্ম রিভিউ

এনিমেশনের প্রতি আমার দূর্বলতা ছোট বেলা থেকেই। কখনো কাউকে এই কথা বলে হয়ে উঠেনি বা কেউ কখনো জানতে চায়নি... তাই হয়তো আমাকে পুরোপুরি কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করতে হয়েছে। তবে এনিমেশনের প্রতি দূর্বলতা থাকলেই যে কমার্স পড়া যাবে না, বিষয়টা আসলে তা না। যার ইচ্ছে থাকে, সে শর্ট কোর্স করেও নিজের প্রাথমিক জ্ঞান টা টুকে নিতে পারে যেকোনো বিষয়ে... তবে আমার ক্ষেত্রে তা ও কখনো হয়ে উঠেনি... এখন নিজে নিজে পরম বন্ধু ‘গুগলের’ সাহায্য নিয়ে একটু একটু করে শিখছি এনিমেশনের কাজ...।

তাই কাজ শিখার একাগ্রতা থেকেই হোক বা শর্টফিল্মের প্রতি ভালোবাসা থেকেই হোক, আমি প্রতিদিন প্রচুর শর্ট ফিল্ম নামাই। আর এগুলোর মধ্যে বেশীর ভাগ থাকে এনিমেশন বেইজড শর্টফিল্ম। কারণ আমার কাছে এনিমেশনের একটা আলাদা সংজ্ঞা আছে। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি একজন মেকার বা পর্দার পিছনের কারিগর তার পুরো ইমাজিনেশন পাওয়ার যেরকম ভাবে এনিমেশন পিছনে লাগাতে পারে, সেরকম ভাবে পারে না মানুষ নির্ভর ফিল্মের ক্ষেত্রে। একজন পরিচালক হয়তো একটা সিনের জন্য বিভিন্ন ক্যারেকটারের মুভমেন্ট, এক্সপ্রেশন যেরকম ভাবে কল্পনা করে রেখেছিল সেরকম ভাবে শটে ফুটিয়ে তুলতে পারে না মানব নির্ভর ফিল্মে। কিন্তু এনিম্যেশন হচ্ছে আপনার হাতের পুতুল, আপনি যেরকম খুশী, যেভাবে খুশী, সেভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পারবেন আপনার ইমাজিনেশন পাওয়ার কে। আপনি যদি ‘Up’ মুভিটি দেখে থাকেন, তাহলে আপনাকে এনিম্যেশনের আরেকটি অনন্যগত সুবিধা সহজে বুঝানো যাবে। ‘Up’ মুভিটির প্রথম ১০ মিনিট দেখার পরপরই আপনি হয়তো আপনার দেখা সেরা শর্ট ফিল্মের তালিকায় এটাকে রাখবেন। ফেইসবুকে অনেককেই  অনেকবারই ‘Up’ মুভির এই ১০ মিনিট এর সাথে ‘Twilight’  সিরিজের এর তুলনা করতে দেখেছি। তারা ‘Twilight’ পুরো সিরিজের প্রেম কাহিনী থেকে হাজার গুন এগিয়ে রেখেছে ‘Up’ এর ১০ মিনিটের সিনটিকে।  রাখাটাই স্বাভাবিক।

তবে কি দেখিয়েছিল ওই ১০ মিনিটের সিনে ? কিছুই না... দুইজন ছোট ছেলে এবং মেয়ের শৈশবের একটি অদম্য ইচ্ছে পূরণের শখ, তরুণ বয়সে তাদের মধ্যকার প্রেমের সময়কার দিনগুলো, মধ্য বয়সের পাওয়া না পাওয়া অধ্যায় গুলো, আর শেষ বয়সে এসে জীবনের হিসাব মিলানোর টুকরো স্মৃতিগুলো... আর এ সব কিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রথম ১০ মিনিটে। অসাধারণ এই সিনটি যে একবার দেখবে তার জন্য সিনটি ভুলে যাওয়া খুব কষ্টকর হবে। এখন বলি ঠিক কি কি কারণে এই সিনটি এতোটা ভালো হয়েছে...



প্রথমেই যে জিনিসটিকে এগিয়ে রাখতে হবে সেটা হচ্ছে, কনসেপ্ট। দূর্দান্ত কনসেপ্ট এর উপর সিনটি দাড় করানো হয়েছে।

দ্বিতীয়তো সিকোয়েন্স গুলো খুব ফাস্ট ফরওয়ার্ড হলেও একটা সিকোয়েন্সকেও আপনি খাপ ছাড়া বলতে পারবেন না।

৩য়তো, কেন খাপ ছাড়া লাগেনি একটি সিকোয়েন্সকেও ? এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে শৈশব থেকে একেবারে শেষ বয়স পর্যন্ত দুইজনের চেহেরা আপনার কাছে খাপ ছাড়া খাপ ছাড়া মনে হবে না। মনে হবে না যে বাছাই করা ছেলে মেয়েদের চেহারা সাদৃশ্যপূর্ণ রাখা কোনো সিন দেখছেন আপনি। আর কেন মনে হবে না, তার উত্তর একটাই...

“এনিমেশন”

আর একজন এনিমেটর এর শক্তি এখানটাতেই। অনেক পক পক করে ফেললাম, এবার আসেন এনিমেশন বেইজড তিনটি শর্টফিল্ম নিয়ে কথা বলি।

..............................................................

'Alma'


পরিচালকঃ Rodrigo Blaas

• Rodrigo Blaas কে চিনেন ? চিনেন না তাহলে ! আমিও চিনি না। তবে সে হচ্ছে Pixar এর একজন সাবেক এনিমেটর। Pixar কি জানেন তো ? Pixar হচ্ছে Steve Jobs এর গড়ে তোলা এনিমেশন স্টুডিও যেখান থেকে এই পর্যন্ত অস্কার জয় করা অনেক এনিমেশন মুভিই রিলিজ হয়েছে। সেসব মুভির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে Toy Story সিরিজ।

Alma শর্টফিল্মটি খুব একটা আহামরি না হলেও কনসেপ্টটা খুব ভালো লাগলো। আসলে গতানুগতিক ধারার বাহিরে যে কোনো কাজ দেখলেই আমার ভালো লাগে। আমার ধারণা এটা শুধু আমার সাথেই হয় না বরং বেশীরভাগ মানুষই এটা পছন্দ করে... শর্ট ফিল্মটিতে ‘Alma’ এর টাইটেল প্রেজেন্টেশন স্ট্যাইলটি বলতে গেলে এক কথা দূর্দান্ত। শর্টফিল্মটি শুরু হওয়ার পর পরই দেখতে পাবেন একটি ছোট্ট মেয়ে একটি নির্জন রাস্তার ‘ডল শপ’ এর বরফের আস্তন পরা আয়নার গ্লাসে নিজের নাম নাম লিখছে বড় বড় করে। এই সিনটি দিয়েই পরিচালক বুঝিয়ে দিয়েছে মেয়েটির নাম যে ‘Alma’। সাথে সাথে পরিচালক এটিও বুঝিয়ে দিয়েছে যে এটাই হচ্ছে শর্টফিল্মটির নাম।

শুরুতেই দেখবেন যে তুষারময় একটি দিনে Alma নামের একটি মেয়ে ডল শপের জানালায় নিজের নাম লিখার পর আবিষ্কার করে যে ঠিক তার মতোই দেখতে একটি পুতুল ‘ডল শপের’ ভিতরে অন্যান্য পুতুলগুলোর সাথে সাজানো রয়েছে। এটা দেখার পর তার মন চঞ্চল হয়ে উঠে। তবে সে পুতুল টিকে ধরে দেখার জন্য ডল শপে ঢোকার অনেক চেষ্টা করেও ঢুকতে পারে না। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে সে যখন চলে আসতে থাকে তখন সে দড়জাটি খোলার আওয়াজ পায়। সে দোকানের ভিতরে ঢুকে কাউকেই দেখতে পায় না। সে তার দুরু দুরু বুকে নিজের মতো দেখতে পুতুলটির কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। সে যখন এগিয়ে যেতে থাকে তখন স্ক্রীণে দেখা যায় অন্যান্য পুতুল গুলো Alma এর দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে আছে। Alma ও এগিয়ে যেতে থাকে পুতুলটির দিকে...



শর্টফিল্মটির আলাদা একটা অর্থ আছে আমার কাছে। শর্টফিল্মটি দেখার পর আমার কাছে মনে হয়েছে আমরা প্রত্যেকেই তো Alma এর মতো হাজার হাজার ফাঁদে পা দিচ্ছি। পা দেওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতেও পারি না যে ফাঁদটানা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে।

এখন দেখেন 'Alma' আপনাদের ভালো লাগে কিনা।

N.B. এই শর্টফিল্মে কিন্তু সূক্ষভাবে আরো কিছু মেসেজ দিয়েছে। ধরতে পারলে পুরষ্কার আছে।


..............................................................................................................................

A Short Love Story



A Short Love Story টিও অনেকটাই ‘UP’ মুভিটির প্রথম ১০ মিনিটের মতোই। কিন্তু তা কোনো নামকরা ব্যাক্তির করা কাজ না। শর্ট ফিল্মটি পরিচালনা করেছে Carlos Lascano। স্টপ মোশন এনিমেশনের মাধ্যমে শর্টফিল্মটি করা হয়েছে। স্টপ মোশন কি জানেন তো ? স্টপ মোশন হচ্ছে পুতুল নাচের ভিডিও এডিটিং ভার্সন। অর্থাৎ Frame by Frame এর শুট নেওয়া হয়েছে, যে কারণে দর্শকদের কাছে প্রতিটি অবজেক্টকেই জীবন্ত মনে হবে। আর পাশাপাশি মনে হবে যেন নিজ থেকেই অবজেক্ট গুলো মুভ করছে। আসলে মুভমেন্টের পিছনে কাজ করে frame by frame বা বায়োস্কোপ থিউরি। বায়োস্কোপ থিউরি এ জন্যে বললাম যাতে আপনার বুঝতে সুবিধা হয় যে আপনি কি উপায়ে ইলুউশন দেখছেন।



কাহিনী সংক্ষেপঃ কাহিনী কিছুই নাই। যা আছে তা হচ্ছে বোঝার ক্ষমতা। স্কুলে বসে থাকা একটি মেয়ের আঁকা পাখি কিভাবে আমাদের কে তার স্বপ্নের ভুবন থেকে ঘুড়িয়ে আনে, তা ই হচ্ছে এই শর্ট ফিল্মের মুখ্য বিষয়। আর কিছুই বলার নাই, বাকিডা সুযোগ থাকলে দেইক্ষা লন...

..........................................................................................................................................

‘Thought of You’



আমার কাছে নির্বাক সব চলচিত্রই অন্যরকম লাগে। নির্বাক চলচিত্রে প্রাণ ঢুকানো পরিচালকদের জন্য বিশাল একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। পরিচালক কে প্রাণ ঢুকাতে হয় মাথা খাটিয়ে, ডায়লগ দিয়ে নয়। Thought of You শর্টফিল্মটা বানাতেও যে পরিচালক Ryan J Woodward কে ‘সেইরাম’ মাথা খাটানো লেগেছে, তা শর্টফিল্মটি দেখে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। অবশ্য শর্টফিল্মটাকে পুরোপুরি ‘নির্বাক’ বলাটা ভুল হবে। এটাতে পরিচালক মিউজিক ব্যবহার করেছে। মিউজিক আর নাচের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে একজন ভাঙ্গা হৃদয়ের মানুষের মানসিক চঞ্চলতা বা অস্থিরতাকে। এই ধরণের অস্থিরতার মর্মার্থ হয়তো তারাই খুব ভালোভাবে বুঝতে পারবে যাদের হৃদয় একবার হলেও ভেঙ্গেছিল। তারা হয়তো নিজেদের মানসিক অবস্থার সচিত্র মোশন দেখে চমকিত হবেন কিছুটা হলেও। আর এখানেই পরিচালকের সার্থকতা। Ryan J Woodward খুব সফলতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন একজন ব্যার্থ প্রেমিকের মানসিক অবস্থানটাকে।



কি করি আমরা প্রেমে ব্যার্থ হউয়ার পর, সারাটাক্ষণ শুধু চিন্তা করি হারানো মানুষটাকে। একটু পর পর শুধু তার কথাই মাথায় আসে। হাজার চেষ্টা করেও ওই চিন্তা গুলোকে যেমন বাস্তবতাতেও রূপান্তর করা যায় না, তেমনি সেই চিন্তাগুলোকে তাড়ানোও যায় না। একটু পর পর মাথায় এসে ভর করে শুধু। আবার যখন মাথায় থাকে না সেসব চিন্তা, আমরা আবারও ব্যাস্ত হয়ে যাই ওইসব চিন্তাগুলোকে জড়িতে ধরে বাঁচার জন্য। তবে সময় কি আর থেমে থাকে !! সময় যায়, চিন্তাও আস্তে আস্তে অপরিষ্কার হতে শুরু করে... একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে হারিয়ে যেতে থাকে অতল গহ্বরতে... তখন কি সেই সব ‘চিন্তা’ রও খারাপ লাগা শুরু করে ঐ ভাঙ্গা হৃদয়ের ব্যাক্তিটির জন্য ?


সমকামিতা, গে সমাচার...ও আমার জীবণের কিছু অভিজ্ঞতা (১৮+)

‘BOB’ এর নাম শুনেছেন আপনারা ?

বব হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র এনাউন্সড গ্রুপ যা হচ্ছে শুধুমাত্র 'গে' দের জন্য। জ্বী হ্যাঁ আপনারা ঠিক ই শুনেছেন, আমি ‘গে’ এর কথাই বলেছি। আমার এক পরিচিত ব্রিলিয়ান্ট বড় ভাই এর মারফতে এই গ্রুপ সম্পর্কে জানলাম। আমার ঐ বড় ভাই গে না হলেও তার একাডেমিক পারপাসে 'বাংলাদেশে গে' দের উপর একটা থিসিস করেছিল। তারই জের ধরে তিনি এই গ্রুপ সম্পর্কে জানতে পারে আরো বছর খানেক আগে। আর আজ জানলাম আমি...

এই হচ্ছে তাদের ফেইসবুক ঠিকানাঃ
http://www.facebook.com/BoBangladesh.LGBT


ওদের পেইজে এ যেয়ে দেখলাম, ২১০০ বেশী লাইক রয়েছে তাদের পেইজ এ। পেইজের একটু নিচে নামার পর দেখলাম ওদের ‘থিম’ বহন করা আরো কিছু পেইজ এর লিঙ্ক দেওয়া আছে। সেসব পেইজের কিছু কিছু ইমেজ রীতিমত গায়ে ‘কাটা’ দেওয়ার মতো। তাই আমি আর ওসব পেইজের ভিতরে যাওয়ার আর সাহস পেলাম না। বরং মূল পেইজেই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম পেইজটার খুঁটিনাটি। গ্রুপটার বেশীরভাগ সদস্যদের কমেন্ট, স্ট্যাটাস পড়ে আমার মনে হলো যে তারা সবাই উচ্চবিত্তের ঘরের উচ্চশিক্ষিত ব্যাক্তি। দেখলাম ওরা প্রতি মাসে বিভিন্ন ধরণের প্রোগ্রাম করে থাকে। নতুন নতুন ‘গে’রা এসব প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারে। এই ধরণের প্রোগ্রাম এর ধরণ ‘ফরমাল’ না বলে ‘ক্যাজুয়াল’ বলাটাই মনে হয় ঠিক হবে। কারণ ওরা এই ধরণের প্রোগ্রামের শুধু ভেন্যু ঠিক করে জানান দিয়ে দেয় তাদের পেইজের মাধ্যমে। তারপর বাকিরা ঐ ভেন্যুতে উপস্থিত হয়ে একটু চোখ কান খোলা রেখে বুঝে নেয় তাদের সদস্যদেরকে। BOB সম্ভবত সর্বশেষ প্রোগ্রামটি করেছে এ মাসের শুরুর দিকে। তাদের সেই ভেন্যু ছিল ‘ধানমন্ডি’ লেকে। আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। দেখার ইচ্ছে ছিল একসাথে অনেক ‘গে’ কে।

আমি অবশ্য অনেক ‘গে’ এর আগে একসাথে না দেখলেও, আলাদা আলাদা ভাবে ৬ জন গে এর সাথে খুব ভালোভাবে পরিচত হয়েছিলাম। আজ আপনাদের তাদের মধ্য থেকে দুই জনের গল্প বলবো। ‘গে’ দের সাথে পরিচিত হবার নিষিদ্ধ দুটি গল্প...


আমি ছোট বেলা থেকেই সকল বিষয়ে কিউরিসিটি ফিল করি, জীবণে খুব কম জিনিস আছে যা আমার করা হয় নাই। আর যে সকল জিনিস এখনো করা হয় নাই তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘গে’ দের সাথে সক্রিয় সম্পর্ক। তবে এই পর্যন্ত আমাকে ৬ জন গে ধরেছে বা প্রাথমিক পরিচয় হয়েছিল। তো আসুন আজ আপনাদেরকে বলি সে ৬ জন গে এর সাথে পরিচয় হউয়ার অভিজ্ঞতা।



১. কুহুঃ
২০০৫ সালের কথা। সময় তখন দিন-রাত ফ্রিতে মোবাইল ফোনে কথা বলার। আমি তখন ব্যবহার করতাম সিটিসেল মোবাইল। আপনারা যারা সেই সময় সিটিসেল ব্যবহার করেছেন, তারা নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন তখনকার রাতের বেলা ফ্রি মিনিটের উৎসবের কথা। আমিও বলতাম কথা অনেক রাত করে, অপরিচিত অনেকের সাথে... ফাউ আলাপ...


সেই সময় আরেকটি অফার সিটিসেল থেকে দেওয়া হয়েছিল, সেটা হচ্ছে ‘সিটিসেল আড্ডা’ (সম্ভবত এই নাম ই ছিল). এই আড্ডা তে আগে নাম রেজিস্ট্রেশন করে চ্যাট এর স্ট্যাইলে মেসেজ করা যেত অপরিচিতদের সাথে। আমিও রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম, অতঃপর ‘কুহু’ নামের একজন আমাকে মেসেজ পাঠালো যে সে আমার ফ্রেন্ড হতে চায়। আমিও হলাম, কারণ নাম শুনে ভাবছিলাম সে একজন মেয়ে। কিন্তু না, সে মেয়ে না, সে হচ্ছে ছেলে এবং আদর করে সে নিজের নাম রেখেছে ‘কুহু’... তো মেসেজে মেসেজে চ্যাট-চ্যাট হতে হতে একসময় সে বলল ফোনে কথা বলার জন্য। আমিও বললাম ঠিক আছে, আপত্তি কিসের !! রাত দিন যেখানে ফ্রি তে কথা চালাচালি হচ্ছে নাম না জানা বিভিন্ন মানুষের সাথে, সেখানে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে পারা সৌভাগ্যের বিষয়। তাই প্রহর গুনতে থাকলাম রাত ১১ টার...


একসময় তার কল আসলো, অপরপ্রান্ত থেকে ‘কুহুর’ কন্ঠস্বর শোনার পর আমার জানি কেমন কেমন লাগলো গলাটা। আমি গলার স্বরটার মিলাতে পারছি ‘না পুরুষের’ সাথে ‘না মেয়েদের সাথে’...তাই অস্বস্থি নিয়ে কথা বলতে থাকলাম। সে তার নিজের সম্পর্কে বলছে অনেক কিছুই বলছে, কোথায় থাকে, কোন স্কুলে পড়েছে, কোন কলেজে, কি খেতে ভালোবাসে, এখন পড়ালেখা করছে ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে’, আরো কত কি। কিন্তু সে একবারও বলল না সে কি মেয়ে না ছেলে, নাকি অন্যকিছু। আসলে কেউ কি আর নিজের জেন্ডার বলে আগ বাড়িয়ে! এটা কি বলার মতো কোনো ব্যাপার! সবাই তো ধরেই নেয় যে কন্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারে অপর প্রান্ত থেকে কে কথা বলছে। সমস্যা হলো আমি ধরতে পারছিলাম না। তাই আউলা মাথা নিয়েই কথা বলছিলাম। একসময় মাথায় আসলো, তাকে আমই তার পুরো নাম জিজ্ঞাসা করলেই তো জানতে পারব সে আসলে জিনিসটা কি। তাই জিজ্ঞাসা করলাম তার নাম। সে বলল, ‘ফুয়াদ রহমান’।

তা আমি বললাম ‘তাহলে কুহু বললেন যে!’।

ও বলল, ‘আদর করে সবাই আমাকে কুহু বলে ডাকে’

এ কথা শোনার পর আমার মন খারাপ হলেও আমি কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। একসময় তার সাথে আমি ফ্রী হয়ে গেলাম। ও হ্যাঁ তাকে আমি মিথ্যা কথা বলেছিলাম কিছু। বলেছিলাম ‘আমি চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ি’, আসলে তখন আমি সবে মাত্র কলেজে উঠেছি। যাইহোক সে প্রতি রাতেই ফোন করতে লাগলো। একসময় সে আমাকে জানালো, সে নাকি ‘গে’। (আমার গে নিয়ে তখন হালকা, পাতলা ধারণা মাথায় ছিল, কিন্তু তখনও কারোও সাথে পরিচয় ছিল না)

আমি বললাম, ‘ও’।

সে বলল ‘চুপ করে গেলে যে!’

আমি বললাম, ‘তুমি এমন কিছুই বলো নাই যেটাতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে হবে। গে হইতেই পারো। এটাতে আলাদা কি বিষয় হইলো !!। (আমি আসলে ভাব ধরার জন্য এই কথাটা বলেছিলাম, কারণ তখনও আমার ধারনা ক্লিয়ার না যে গে এর সংখ্যা কি হাতে গোণা নাকি প্রচুর। তাই আমাকে ভাব ধরতে হলো)।

সে তারপর বলল, ‘তাহলে আমাকে চুমো দিয়ে দাও তো’।

আমি মনে মনে বললাম, ‘হ্যাএ এ এ, খাইছে আমারে, অহন কিতা করতাম !!’ আর মুখে বললাম, ‘কোথায় চুমো দিয়ে দিবো বলো ?’

সে বলল, “কোথায় আবার!  ঠোটে চুমো দিয়ে দাও”

আমি মনে মনে ভাবলাম, “শালার আমারার লগের পোলাপাইন ফোন সেক্স করে মাইয়াগো লগে, আর আমি এখানে চুম্মা দিমু এখন এক বেমাডা পোলারা। শালার কপাল আমার...” আর মুখে বললাম, “একটু দ্বারাও, আমি দড়জাটা বন্ধ করে আসছি” (আসলে দড়জা বন্ধই ছিলো, আমি যেটা করছিলাম সেটা হচ্ছে পিসি অন করেছিলাম। মনিকা বেলুচির একটা পিক বের কইরা আবার ফোনে গেলাম)

সে বলল, “কই !! আসো না...”

ফোনে শুরু হলো রসের আলাপ তার। একটু পর পর বলে চুমু দিয়ে দিতে। আমিও দিয়ে দেই। সে আমাকে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে পড়নের শার্ট খোলার জন্য, আমি তাকে বলি হ্যাঁ ডার্লিং খুলেছি (আসলে হুদো), তারপর সে আমাকে বলে তোমার বুকে আমি হানি ঢালছি ডার্লিং, আমি বলি, “এতো ঢালছো কেন !! দুষ্টু কোথাকার...” আর মনে মনে কই “শালা হানি কি মাগনা পাইছস!! এদিকে মাইনসে খাওয়া পায় না, আর এই লুইচ্চায় হানি ঢালে...”

এভাবেই ১৫-২০ দিনের মতো ফোনে তাকে হুদাই আনন্দ দিতাম আমি। শুনেছি মানুষকে আনন্দ দেওয়ার মধ্যেও নাকি সোয়াব আছে। তাই আমিও সোয়াব কামাইতাম... আর ‘কুহু’ ও হানি ঢালতো...

.......................................................................................................................................


২. জাহাঙ্গীর গেঃ

আমার ধরণা কুমিল্লার পোলা পাইন সবাই জাহাঙ্গীর গে কে কম বেশী চিনে। আর তা চিনে শুধুমাত্র ফাহিমের কারণে।

ফাহিম হচ্ছে কুমিল্লা শহরের একজন খ্যাতিমান ব্যাক্তি, তাকে চিনে না এমন পাবিলিক কুমিল্লা শহরে আছে হাতেগোনা কয়েকজন। ফাহিমের ভাষ্যমতে কুমিল্লা শহরের ৬৭ ভাগ নারী নাকি তার সাথে বিছানা শেয়ার করেছে।

আমি বললাম, “তাহলে বাকি ৩৩ ভাগ কি দোষ করলো?”

সে তখন বলছিল, “বাকি ৩৩ ভাগ এর মধ্যে ২৫ ভাগ এর বয়স হইতেছে গিয়া তোর হয় ১৩ এর নিচে আর না হয় ৬০ এর উপরে”

 “আর বাকি ৮ ভাগ ?”

সে তখন একটা মুচকি হাসি দিয়া বলছিল, “বাকি ৮ ভাগের মধ্যে ৫ ভাগ মাইয়া হইতেছে গিয়া তোর আমার আত্মীয় স্বজন, আর বাকি ৩ ভাগ হইতেছে তোর ‘প্রতিবন্ধী’, আর আমি প্রতিবন্ধীদের সাথে বিছানা শেয়ার করি না।“

এই হচ্ছে আমার বন্ধু ফাহিম, আর এর কল্যাণে আজ ‘জাহাঙ্গীর গে’ ও কুমিল্লা শহরে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। আর এই ‘জাহাঙ্গীর গে’ কে সে চিনেছে আমার মারফতে.....


জাহাঙ্গীর গে র প্রধান টার্গেট হচ্ছে কুমিল্লা জিলা স্কুলের কোমলমতি শিশুরা। আমারও তার সাথে পরিচয় স্কুলের সামনেই।


আমি কুমিল্লা জিলা স্কুলে ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ছিলাম। ম্যাট্রিক পাশ করার পর চাঁদপুরে দেশের বাড়িতে চলে আসি। এর পর মাঝে মধ্যে কুমিল্লায় যাওয়া হতো মায়ের সাথে। তবে অনেকদিনের জন্য একবার গিয়েছিলাম H.S.C পাশ করার পর। সেই চেনা শহর, চেনা অলি গলি... যাইহোক মূল প্রসঙ্গে আসি, বলছিলাম ‘জাহাঙ্গীর গে’ এর কথা।

দুপুর ১২ টার দিকে পুরনো সেই ‘স্কুল ছুটির’ দৃশ্যটি সচক্ষে দেখার জন্য গিয়েছিলাম জিলা স্কুলের সামনে। স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্টের সেই চিরচেনা ড্রেসগুলো। এমন সময় হোন্ডায় করে এক লোক এসে দাঁড়ায় আমার সামনে। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি স্কুলের কারো জন্য অপেক্ষা করছি কিনা ? আমি বললাম হ্যাঁ, করছি। সে জানালো তারও ভাইগ্না নাকি এই স্কুলেই পড়ে। সে ও অপেক্ষা করছে। তো টুক টাক কথা বলার এক পর্যায়ে সে আমাকে বলে,

“স্কুল ছুটি হতে তো অনেক দেরি, চলো আমরা পার্কের থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসি”

আমি একটু ভেবে বললাম, “চলুন”


আপনারা হয়তো ভাবছেন, এতো সহজে চট করে একজন অপরিচিতর কথায় কেন রাজি হয়ে গেলাম। একজন অপরিচিত মানুষের কথায় চট করে রাজি হয়ে যাওয়ার পিছনে অবশ্য আমার একটা কারণ ছিলো। আর কারণটা হচ্ছে, সে আমাকে চিনতে না পারলেও, আমি তাকে চিনতে পেরেছিলাম ঠিকই। এই লোকটাই আমি ক্লাস নাইনে থাকতে পথের মাঝে আমাকে ধরেছিল একবার। আমি তখন ছিলাম সাইকেলে, আর সে তখন ছিল একটা মাইক্রোবাসে বসা। আমার স্পট মনে আছে, সে আমার নাম জিজ্ঞাসা করার পর আমাকে বলেছিল,
“তোমার মতো একটা ছোট ভাই আছে আমার, সে এখন বিদেশে থাকে, তোমারে দেইক্ষা আমার তার কথা মনে পরছে”। 

আমি এর জবাবে কি বলেছিলাম আমার তা মনে নেই, তবে আমার যে প্রাইভেট কোচিং এর জন্য দেরি হচ্ছিল, তা স্পষ্টভাবে মনে আছে। তারপর টুক টাক কিছু কথা বলার পর সে আমাকে বলল

“মোবাইল ফোন নিবা নি ?”।

আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম, কারণ ২০০৩ সালের দিকে মোবাইল ফোনছিল গুটি কয়েক মানুষের কাছে। আর সেই সময়েই আমাকে সে মোবাইল অফার করাতে আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম...

তাই সে যখন আমাকে পার্কে যাওয়ার কথা বলেছিল, আমার মনে পরেছিল ঠিক সেই দিনের ঘটনাটি। ৯ এ পড়ার সেই সময়ের কথা আমার মাথায় কাজ করছিল ম্যাট্রিক পাশের পর জিলা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে। আর আমার সামনে দাড়িয়েছিল ‘জাহাঙ্গীর গে’, তাই কথা না বাড়িয়ে উঠে গিয়েছিলাম তার হোন্ডার পিছনে... সে আর কি ই বা করবে... কুমিল্লা শহরটা তো আমারই একটা অংশ।


হোন্ডায় যেতে যেতেই সে আমাকে বলে তার নাকি গাড়ির বিজনেস আছে। টাকা পয়সা নাকি ভালোই কামাইছে। এরপর ঈদ্গার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে আমাকে দেখাতে থাকে পার্ক করা তার মাইক্রোগুলো। (কুমিল্লা শহরের মাইক্রো এর পার্কিং স্ট্যান্ডটা ঈদ্গার পাশেই)... এরপর আমরা আসলাম পার্কে... পার্কে নিয়ে যাওয়ার পর সে আমাকে কোনো উথাই পাথাই না করে সরাসরি বলেছিল,

“আমার লগে করবা নি ? তোমারে আমি ৫ হাজার টাকা দিমু”

(পার্কের মতো নির্জন জায়গায় এই কথা শোনার পর অন্য কেউ থাকলে হয়তো ভয় পেয়ে যেত, আমি একটুও পাইনি)...আমি ঠান্ডা মাথায় বলেছিলাম,

“কি করবো ?”

সে ততক্ষণে আমার হাতের মাসল টিপা শুরু করছে। সে এক টিপ মারে আমিও দেই দুই তিন লাফ... এক পর্যায়ে আমি তাকে বলি,

“আচ্ছা আমাকে চিন্তা করতে হবে, আপনি আপনার নাম্বারটা আমাকে দেন, আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করবো, এখন তো আমাকে স্কুলে যেতে হবে...”।

সে আমাকে বলে,

“আরে এখনকার সময়ে এডি কুনো ব্যাপারই না, মজা পাইবা তুমি। আমি কুয়েতে থাকতে কত করছি। তোমার ইচ্ছা হইলে করবা, না হইলে করবা না। তয় তোমারে আমার যেই ভালা লাগছে“ (এই কথা বলে সে আবার আমার হাত টিপা শুরু করছে)

আমি বললাম, “আচ্ছা আপনি আমাকে আপনার নাম্বার দেন, আমি আপনাকে কল করবো। আমার একজন পরিচিত আছে সে হয়তো করতে পারে”

সে বলে “না তুমি রাজি থাকলে, আমি তোমারেই করমু” 

এরপর সে তখন তার ম্যানিব্যাগ থেকে একটা ছোট নোটবুক বের করে, বের করে আমার নাম্বার তার নোটবুকে টুকে রাখে, আর তার নাম্বার সে আমাকে দেয়। আমি তার নোটবুক দেখেই বুঝেছিলাম এখানে সে তার সব ভিক্টিমদের নাম্বার টুকে রেখেছে। যাইহোক সে আবার হোন্ডা স্টার্ট দেয়। আমি আবার তার হোন্ডার পিছনে উঠি। এবার সে হোন্ডা চালায় আর বাম হাত দিয়ে আমার বাম পাশের রানে টিপ মারতেছে... আমি পারিনা হুন্ডার থেকে লাপ মারি...


তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই এই কাহিনী আমি আমার বন্ধু শুভ্র আর ফাহিম কে বলি। বলার পর কেউ ই প্রাথমিক অবস্থায় আমার কথা বিশ্বাস করে নি। ফাহিম আমকে বলে,

“আরে বেডা আমারে ২০০০ দিলেই তো আমি কইরা ফেলতাম, কিতা আর ঢুকাইবো তে, তুই বেডা মিছা কাহিনী লইয়া আনছস আমরার কাছে”

আমি তখন ওদের সামনে লাউড স্পিকারে জাহাঙ্গীর গে রে ফোন করি। তাকে বলি যে আমার এক ফ্রেন্ড আছে যে কিনা আপনার প্রস্তাবে রাজি আছে... সে অপর প্রান্ত থেকে বলে

“আইচ্ছা আমারে আগে দেখা লাগবে তারে, সন্ধ্যার সময় তুমি তারে নিয়া আইসো ঈদগার সামনে”

আমি বললাম 'আচ্ছা... '


তারপর ঈদগায় তে কি হয়েছিল সেদিন তা আর আমি বলতে চাচ্ছি না... ঐটা ফাহিমই ভালো বলতে পারবে। কারণ সেদিন নির্জন এলাকায় আমি কি দেখেছিলাম সেটা শুধু আমিই জানি, আর  ফাহিম কি অনুভব করেছিল ঐটা শুধু সে ই জানে..

স্কুল পালানোর গল্প...

স্কুল পালিয়েছন কখনো ? চুপি চুপি করে স্কুলের মূল ফটক বা পিছনের বাউন্ডারির দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ‘দূরু’, ‘দূরু’ বুকে ভো দৌড় দিয়েছেন কখনো ? যে দৌড় দেওয়ার সময় কখনোই মাথায় আসেনি ‘ধরা পরলে কি হবে’ বা ‘মাইর কি হাতে খাবো না বেত দিয়ে’... পালিয়েছেন কখনো স্কুল ?

আজকে  আপনাদেরকে একটা গল্প বলি। গল্পটা হয়তো আপনাদের ভালো লাগবে না... তারপরও বলি... আমার স্কুল পালানোর গল্প ...

২০০৪ এর কথা হবে। আমি তখন পড়ি কুমিল্লা জিলা স্কুলের মর্নিং সিফটে। মর্নিং সিফটের সময় সূচি ছিল সকাল ৭ টা হতে ১২টা। আর টিফিন আওয়ার ছিল ১০ টা থেকে ১০টা ১৫ পর্যন্ত, যাকে বলা হয়ে থাকে স্কুল পালানোর সব থেকে উৎকৃষ্ট সময়। আমার ধারণা সরকারকর্তিক যদি স্কুল পালানোর কোনো সময় সূচি নির্ধারণ করা হতো, তাহলে তা হতো ‘১০টা থেকে ১০টা ১৫’ এর মধ্যে। তবে আফসোসের বিষয় হচ্ছে সরকারও যেরকম কোনো সময়সূচী ঘোষণা করেনি, সেরকম আমাদের স্কুলও না। বরং আমাদের স্কুল থেকে ‘হুলিয়া’ জারি করা হয়েছিল ‘বিদ্রোহীদের’ উপর। আর তাই যখন এসকল ‘বিদ্রোহী’দেরকে কুমিল্লা শহরের চিপা-চুপা থেকে ধরে আনা হতো, তখন সারা স্কুলে মাইরের দামামা বাজতো। আর এসব বিদ্রোহীদের উপর চালানো বেত্রাঘাতও আমরা উপভোগ করতাম মনভরে... কত রকম, কত কায়দায় আর কত রকম ‘খিস্তি’ দিতে দিতে যে স্যারেরা যে এসব বিদ্রোহীদের ‘পিডাইতো’ তা শুধু ওরাই জানবে যারা কুমিল্লা জিলা স্কুলে একদিনের জন্য হলেও ক্লাস করে থাকবে। আর মাইর খাওয়ার সময় বিদ্রোহীদের অঙ্গভঙ্গিও করতো দেখার মতো। আপনাকে উদাহরণসহ বললে হয়তো সহজে বুঝতে পারবেন। ‘মাইকেল জ্যাকসনের’ নাচ দেখেছেন কখনো ? যদি দেখে থাকেন তাহলে শুনে রাখুন চৌধুরি সাহেব, সেই নাচ কেবল মাত্র আপনিই দেখননি... আমরাও দেখতাম প্রতিদিন স্কুলে ক্লাস করার সময়। মিউজিক ছাড়া বিদ্রোহীদের ওঃ সে কি নাচ... তবে মিউজিক না থাকলেও ‘বিদ্রোহীরা’ র‍্যাপ করতে করতে নাচতো বেশীরভাগ সময়...

“স্যার... ছ্যার... স্যার... ভু...ল হয়া গেছে স্যার...
মাফ কইরা দেন... ছ্যা...র... ছ্যার স্যার, স্যার... স্যার...
আর করমু না স্যার, স্যার... ছ্যার... ছ্যার...”

আর এসব র‍্যাপারদের কে ফিচারিং করতো আমাদের স্যাররা... খিস্তি দিতে দিতে... কি সব খিস্তি দিতো তার যদি ১০% আমি লিখি, আমি নিশ্চিত আমাকে সামু থেকে ব্লক করা হবে চিরেদিনের জন্য। তারপরও বলছি, ধরুন একজন বিদ্রোহীকে ধরে আনা হয়েছে পেটলা শাহজাহানের সামনে। (পেটলা শাহজাহান হচ্ছে আমাদের স্কুলের নামকরা বদরাগী স্যারদের মধ্যে অন্যতম। স্যার যদিও ছিল ছোট খাটো সাইজের, কিন্তু তার পেটটা ছিল ডাবল জমজ বাচ্চা প্রসব করা প্রেগনেন্ট রোগিদের মতো, আর স্যার পেন্টটা পরতো ঠিক তলপেটের একেবারে নিচের দিকে, যেখানে গিয়ে... থাক আর বললাম না, আশা করি বুদ্ধিমান পাঠক বুঝতে পেরেছেন। যাইহোক পেটলা শাহজাহান ছিল জিলা স্কুলের অন্যতম আতংক। স্কুল ছুটি হওয়ার পরও পোলা-পাইন ভয়ে থাকতো, কখন না আবার ‘পেটলার’ সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। কথিত আছে কুমিল্লা শহরের জিলা স্কুলে পড়ুয়া ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ স্রেণীর ছাত্ররা যদি নাকি রাতের বেলা না ঘুমাতো যেত, তাহলে তাদের মা তাদেরকে বলতো, “শুয়ে পর লক্ষ্মী সোনা বাবু, না হয়তো পেটলা শাহজাহান খেয়ে ফেলবে তোমাকে” এর পর বাচ্চারা আর দেরী করতো না। ছু ছু করে এসেই শুয়ে পরতো লক্ষী সোনা বাবুদের মতো।) পেটলা শাহজাহান চেয়ারে বসে থাকা অবস্থাতেই বাম হাতে ভিকটিম এর কলার চেপে ধরে প্রথমে ৪-৫ টা ঝাকি দিতো। ঝাকি আবার লম্বা লম্বি ভাবে দিতো না, দিত ডানে বামে করে, অনেকটা পেন্ডুলামের মতো লাগতো তখন ভিকটিম কে। ঝাকি দিতে দিতে খুব শান্ত ভাবে বলত,

“এই তোর ‘ফাদারের’ নাম বল?”

ভিকটিম তার ফাদারের নাম কাঁপা কাঁপা গলায় বলতো ঝাকি খেতে খেতে...

“আরে ফোকিরন্নির পোলা, তুই তোর এই ফাদারের নাম বল” 

পেটলা শাহজাহান এই কথা বলতো নিজের দিকে ডান হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে। এরপর পরই শুরু হতো ফুটবল খেলা। পেটলা শাহজাহান এতক্ষণ ধরে ওয়ার্ম আপ করার পর ভিকটম নিয়ে শুরু করতো তার ফ্রী হ্যান্ড ফুটবল খেলা, যেই খেলার রেফারির নাম হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’, কোচের নাম হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’, টিমের নাম হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’ এমন কি একমাত্র প্লেয়ার এর নামও হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’।

আপনি হয়তো এখন জিজ্ঞাসা করতে পারেন,

‘আপনি না বললেন ভিকটিম এর সাথে খেলা শুরু করার কথা !! তাহলে প্লেয়ার একজন কেন, প্লেয়ারতো দুজন হউয়ার কথা!! তাই নয় কি ?’

জ্বী, তাই। তবে এক্ষেত্রে ভিকটিম প্লেয়ার হিসেবে নয় বরং তার অবতার হয় ‘ফুটবল’ হিসেবে। শাহজাহান স্যার খিস্তি দিতে দিতে কখনো তাকে দেয়ালের সাথে বারি মারে, কখনো তাকে লাথি মারে, কখনো তাকে নিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ খেলে। আর বলে,

‘তুই নাকি তোর বাপের জাইঙ্গা পইড়া স্কুল পালাইছোস ?’ ‘কথা বল হা______, কথা বল চো_______, কথা বল... কথা বল...’ 

এভাবে মাইর ফিচারিং খিস্তি চলতেই থাকতো, যতক্ষণ না স্যার এর ইচ্ছা করে থামার...

এতসব মাইর দেখা ও খাওয়ার পর ও আমরা পালাতাম। স্কুল পালানোটা ছিল আমাদের কাছে নেশার মতো। যে নেশাকে পেটলার মাইর ও দমতা পারেনি... স্কুল পালানো সেই সময়ে ছিল জিলা স্কুলের ট্রেন্ড। সবাই পালায়, এমনকি আমাদের ক্লাস কেপ্টেনও। পালানোর কোনো নির্দিষ্ট সময় সূচি ছিলো না। যে যার মতো সুযোগ পেলেই পালাচ্ছে। কেউ পালাচ্ছে ২য় পিরিউডে, কেউ পালাচ্ছে ৫ম পিরিউডে, কেউ টিফিন পিরিউডে, আর কেউ কেউ একেবারে ৭ম পিরিয়ডে এসে! তাই পিরিয়ড এখানে মূখ্য বিষয় না, পালানোটাই হচ্ছে মূখ্য বিষয়।

আমি পুরো স্কুল জীবনে হাতে গোনা  ১৪ কি ১৫ দিন পালিয়েছি। এই ১৫ দিনের ১০ দিনই হয়তো টিফিন পিরিউডের পর পালিয়েছি। ও সে কি অভিজ্ঞতা .... স্কুল পালানোর মূহুর্তটার অভিজ্ঞতা বা তৃপ্তি বলে বোঝানো অসম্ভব। যারা কখনো স্কুল পালান নি তারা তার স্বাদ কখনোই বুঝার চেষ্টা করলেও কখনোই বুঝতে পারবেন না। যদিও স্কুল পালানোর পর তেমন কিছুই করার থাকতো  না। করার কিছু থাকতো না, কারণ আমার রাস্তার পাশের ভিডিও গেমসর প্রতি আসক্ত ছিলাম না, ক্রিকেট-ফুটবল কিছুই খেলতে পারতাম না... শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম... তারপরও ওই সময়গুলো ছিলো আমার কাছে স্বপ্নের মতো।

১৯৯০ - ২০০৭ সাল পর্যন্ত ছিল মিসেস সাবিনা গণির অর্থাৎ আমার মায়ের ছিল 'কড়া শাসনামল'। আমার মা আমার পড়াশোনা নিয়ে কখনোই ডাক দেইনি, কিন্তু কখনো বাহিরের জগতের সাথে মিশতেও দেইনি। স্কুল আর একটা প্রাইভেট পড়া ছাড়া আমার একটা মিনিটও বাহিরে থাকার অনুমতি ছিলো না, এমনকি ঈদের দিনও না। সারাদিন বাসায় থাকতে থাকতে আমি চার দেয়ালের মাঝে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। তাই সম্পদ যে দিন আমাকে নিয়ে প্রথম স্কুল পালালো, সেদিন ছিল আমার জীবনের একটি স্বরণীয় দিন। কুমিল্লা শহরের ঈদগাহ, পার্ক, ধর্মসাগরের পাড়, অজানা রাস্তার অলিগলিতে দুইজন উদ্যেশ্য বিহীন ভাবে ঘুরতে লাগলাম টোকাইদের মতো। যা যা দেখছিলাম, তার সবকিছুই মনে হচ্ছিল চক চকে নতুন টাকার মতো নতুন। যেই নোট খরচ করার বদলে পকেট থেকে একটু পর পর বের করে হাত নেওয়ার মতো মনে হচ্ছিল। সময় যে কখন চলে যেত, টেরই পেতাম না...ছোট মামার দেওয়া ডায়ালের কালার চেঞ্জ হওয়া ঘড়িতে একসময় আবিষ্কার করতাম, বাসায় ফিরে যাবার সময় হয়েছে।  প্রথমবার পালানোর দিন বাসায় ফিরে আসার পর প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছিলাম, আমি বাসায় চার দেয়ালের মাঝে বন্দী। এর বাহিরেও একটি পৃথিবী আছে...

এরপর দিন থেকে সম্পদকে আর বলা লাগেনি পালানোর কথা। নিজ উৎসাহে দিতাম ভো দৌড় ...ভিডিও গেমস, ক্রিকেট, বা কোন খেলার উদ্যেশ্য নিয়ে নয়... এক টুকরো হারানো শৈশব ফিরে পাবার উদ্দেশ্য নিয়ে পালাতাম স্কুল।

কিন্তু আমার উদ্দেশ্য একদিন ধূলোয় মিশে গেল, যেদিন ধরা খেলাম একেবারেই হাতে নাতে। কিন্তু সেদিন আমার ধরা খাওয়ার এতটুকুও সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ তারপর দিন থেকেই স্কুল বন্ধ ছিল ১ মাসের জন্য। সেদিন সকালে স্কুলের মূল ফটকে ঢুকার আগেই সম্পদের সাথে দেখা হয়ে যায়। দুইজনই সিদ্ধান্ত নেই, আজ একটি ক্লাসও করবো না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সেই জায়গায় আরো একজন সেখানে উপস্থিত ছিল। আর সেই ছেলেটির নাম 'শাহ্ ইমরান রানা ', যাকে তার কিছুদিন আগেই আমার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম ভয়ে ভয়ে। ভয়ে ভয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম কারণ আমার বাসায় আমার কোনো বন্ধুদের আসা নিষিদ্ধ ছিলো। কেন নিষিদ্ধ ছিলো আমি জানি না, শুধু জানি নিষিদ্ধ ছিলো। তারপরও আমি রানাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের বাসায়। আর সেই নিয়ে যাওয়াই আমার জন্য কাল হয়েছিল। না... আমার মা তাকে কিছুই বলেনি, বরং আদর করে বিস্কিট খাওয়েই ছিল। সেই বিস্কুট খাওয়ানোটাই আমার জন্য কাল হয়েছিল। না.... আমার মা রানা যাওয়ার পরেও আমাকে কিছুই বলেনি। বরং বলেছিল, 'ছেলেটা তো ভিষণ ভদ্র '।আর সেই 'ভদ্র ' ছেলেটাই আমার জন্য কাল হয়েছিল।

শেষ যেদিন সাহস করে প্রথমবারের মতো, প্রথম পিরিয়ডের আগে স্কুল পালালাম ... সেদিনও আমি ভেবেছিলাম আমি 'স্বাধীন '... কিন্তু সেই ধারনা মাথার ভিতরে ধারনা অবস্থাতেই থাকলো যখন আমার দেখা ১২ টার দিকে 'জহির ' স্যারের সাথে হলো। স্যার দেখা মাত্র টক টকে লাল দুটি চোখ নিয়ে আমাকে বললো

"কিতারে, তুই রূপালীতে ছবি নি দেইখ্যা আইলি? আর এহানে তোর মা এ পুরাডা স্কুল এক কইরা লাইছে। হেই বেডিয়ে মনে করছে তোরে কিডন্যাপারে নি নিয়া গেল। তাড়াতাড়ি বাসাত যা... "

 আমি নিশ্চিত, আমি তখন ফটিকের মতো ফ্যাল ফ্যাল চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার হার্টবিট তখন মাপলে হয়তো ডাক্তারেরও হার্ট এট্যাক হয়ে যেতো। একবার ভাবতেছিলাম, মায়ের হাতে পরার চাইতে ভাইজ্ঞা অন্য কোথাও চলে যাই... চট্টগ্রামের দিকে কোনো এক গ্রামে, শুনছি সেখানে নাকি ভাড়ায় মাল-পত্র বোঝাইয়ের জন্য ভাড়াটে কামলা নেওয়া হয়। মায়ের হাতে পরার চাইতে কামলাগিরি করা বহুত ভালো। আবার স্কুল খোলার পর ধরবে পেটলা শাহজাহান...

আমি সেদিন প্রথমবারের মতো আরেকটা প্রতিভা আমার ভিতরে আবিষ্কার করলাম... আর তা হচ্ছে ...'অভিনয় '... আমি রিকশায় বসে প্রথমে আমার নিজের শার্টের তিন চারটে বোতাম ছিড়লাম। তারপর রিকশা থামিয়ে হাতে বালু নিয়ে প্যান্টে শার্টে ঘসাঘসি করে দাগ ফেলানোর চেষ্টা করলাম। তারপর আমার প্রিয় ছোট মামার দেওয়া হাত ঘড়িটা রিকশাওয়ালা কে দিয়ে দিলাম। মায়ের মাইরের ভয়ে স্যারের এমনি এমনি কওয়া 'কিডন্যাপের ' কাহিনীডা আমার পছন্দ হয়েছিল বেশ। তাই তারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ...

আমি বাসায় এসে কারও কাছেই মার খাইনি, বরং আমার বাবা মাইনুদ্দিন ব্যাকারির একটা বার্গার না কি যেন এনে ছিলো তা খেয়েছিলাম। 'মাইনুদ্দিন ব্যাকারির 'কথা লিখতে একটা জিনিস মনে পড়লো (মাইনুদ্দিন বেকারী শাহ ইমরান রানাদের ছিলো)... সেদিন স্কুল পালানোর ঘটনা 'শাহ ইমরান রানাই ' স্যার কে রিপোর্ট করেছিল এবং স্বউৎশাহে স্যারকে বলেছিল যে, সে আমাদের বাসা চিনে ... এবং আমাদের বাসায় এসে কমপ্লেইন করতেও তার কোনো আপত্তি নেই ...

এরপর আর পালাইনি স্কুল... বন্দী হয়েই ছিলাম অনেকদিন পর্যন্ত... সেই চার দেয়ালের জাঁতাকলে...

বই রিভিউঃ The 3 Mistakes of My Life

চেতন ভগতকে চিনেন ?

ওকে না চিনলেও আমার বিশ্বাস ওর লেখা আপনারা সচক্ষে উপভোগ করেছেন খুব ভালোভাবেই। আর তা হচ্ছে 3 idiots চলচিত্রটি যা কিনা তার লেখা Five point someone এর উপর ভিত্তি করে বানানো। যা পরবর্তীতে তিনশত কোটি রুপির রেকর্ড গড়েছিল। যে চলচিত্রের রেকর্ড এখন পর্যন্ত অন্য কোন ভারতীয় চলচিত্র টপকাতে পারেনি। অবশ্য এই সাফল্যের পুরোটাই তাকে দেওয়া ঠিক হবে না বরং কারও কারও কাছে তা  হাস্যকর ঠেকাবে! কারণ তার লেখা উপন্যাস এর উপর ভিত্তি করে বলিউডে আরো একটি চলচিত্র রিলিজ হয়েছিল। সেটা হচ্ছে ‘Hello’, যেটা আলোর সাফল্য দেখিনি পরবর্তীতে। তবে এ বছর The 3 Mistakes of My Life এর উপর ভিত্তি করে ‘Kai Po Che!’ নামে যে চলচিত্রটি রিলিজ হয়েছে, তা সমালোচকদের ভালো নজর কেড়েছে। চলচিত্রটি এখনো আমার দেখা হয়নি, তবে বইটি অনেক আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। তাই আপাতত কাচা হাতে এই বইয়ের রিভিউটা লিখে ফেলার জন্য বসেছি আজ। চলচিত্রটি না হয় পড়ে দেখা যাবে।

'Kai Poche!' মুভির পোষ্টার 


(শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভালো, আর তা হচ্ছে আমি এই বইয়ের টুইষ্ট নষ্ট করবো না। তাই স্পয়লার হওয়ার কোনো চান্সই নেই। )

বইয়ের প্রচ্ছদ


3 mistakes of my life হচ্ছে চেতন ভগতের লেখা ৩য় উপন্যাস, যা ২০০৮ সালের বেস্টসেলিং বই গুলোর একটি। উপন্যাসের গল্প গড়ে উঠেছে ভারতের আহমেদাবাদ শহরে বেড়ে উঠা ৩ বন্ধুকে নিয়ে। তাদের প্রত্যেকের জীবনের উদ্দেশ্যই একে অপরের থেকে আলাদা: ‘গোবিন্দের’ লক্ষ্য টাকা বানানো; ‘ইশানের’ লক্ষ্য যে করেই হোক ক্রিকেটের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখা আর গল্পের ক্ষুদে প্রতিভাবান  ব্যাটসম্যান আলীকে সেরা ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলা; আর ৩য় প্রধান চরিত্র  ‘অমি’ এর নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই, সে শুধু চায় তার বাকি দুই বন্ধুদের সাথে যেকোন উপায়ে থাকতে।

নামকরণ :


বইটির নামকরণ আমি বলবো পুরোপুরি ভাবেই সার্থক। চট করে সার্থক বলিনি আমি,অনেক ভেবেচিন্তে বলছি। যদিও এই বইটি আমার পড়া সেরা বইয়ের মধ্যে পড়বে না, তারপরও জোড় গলায় বলবো অনেক  উপন্যাসগুলোর চাইতেও এর নামকরণ অনেক ক্ষেত্রেই সার্থক। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি হূমাওয়ন আহমেদের কথা। অন্যান্য অনেকের মতো আমিও আমি হুমায়ূন আহমেদের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলাম এককালে (এখনো তার কিছু কিছু বইয়ের বিশাল মাপের ভক্ত), তার বেশিরভাগ লেখা আমি গ্রেগার্ছে গিলেছিলাম একসময়। এবং আমি এখনো স্বীকার করি তার কিছু লেখার কাছে শুধু বাংলাদেশেরই নয় বরং বিশ্বের নামকরা কিছু লেখকও কখনো যেতে পারবেনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য অধিকাংশ বইয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ খুব একটা ছাপ রেখে যেতে পারেননি। আমার ধারণা নামকরণ নিয়ে হূমায়ন আহমেদের কোনো মাথা ব্যাথাও ছিলো না কোনোদিন। কিন্তু চেতন ভগতের বিষয়টা ভিন্ন। তার প্রত্যেকটা বই এর নাম ই পাঠকের মনে কৌতহল জাগাতে সক্ষম। ‘The 3 Mistakes of My Life’ বইটার ক্ষেত্রেও একথাটি খুব ভালোভাবে প্রযোজ্য। আপনি যদি কোনো একটা বুক স্টলে যেয়ে শুধু এর কভার পেজটি দেখেন, আপনার ইচ্ছে করবে বইটি একটু উল্টে পাল্টে দেখার। আর আপনি যখন উল্টে পাল্টে দেখতে থাকবেন তখনই আপনার মনে বইটি কিনে ফেলার একটা সূক্ষ আগ্রহ জন্মাবে। আর আমি মনে করি যেকোন লেখকের জন্য এটাই হচ্ছে ‘প্রাথমিক সাফল্য অর্জন’, আর তা হচ্ছে আগে থেকে কোনো ধারণা না রেখেও একজন পাঠক যখন মনের অজান্তে কোন একটি অপরিচিত বই সর্ম্পকে কৌতূহলী হয়ে উঠে।

আপনি যখন The 3 Mistakes of My Lifee এর পেপারবুক ভার্সনটি হাতে নিবেন, দেখবেন টাইটেল এর Mistakes এর উপর কাটা দাগ রয়েছে। অর্থাৎ আপনি যদি ‘Mistakes’ ছাড়া লাইনটি পড়েন তাহলে তা দাঁড়ায়, ‘the 3 of my life’. এই টাইটেলটি যখন পাঠকের মাথায় আসবে, সে তখন বুঝতে পারবে এখানে 3 mistakes ছাড়াও গল্পকথকের ৩ জন কাছের মানুষের কথা বুঝানো হয়েছে। তাই গল্পকথকের জীবনের কাছের তিনজনকে এই টাইটেলে বুঝানো হয়েছে বলে মেনে নিতে পারেন। আবার পুরো উপন্যাস জুড়ে তিনটি বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে সবথেকে বেশী,  আর তা হচ্ছে 'ক্রিকেট, ধর্ম, আর বিজনেস'।
তাই চাইলে আপনি এই তিনটি বিষয়ও যে টাইটেলকে ‘রিপ্রেজেন্ট’ করছে, তা ও মানতে পারেন।


আবার আপনি যদি Mistakes সহ টাইটেলটি ধরেন, তাহলে মনে হবে গল্পকথক তার জীবণের করা তিনটি ভুলের কথা বলেছে। তাই নামকরণের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই।


সারসংক্ষেপঃ

 ‘গোবিন্দ’ হচ্ছে এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আর একইসাথে গল্পকথক। নিতান্তই সাধারণ গোছের একজন যার মাঝে যে কেউ নিজের ছায়া খুজে পেতে পারেন। তার আকাংখা বলতে গেলে একেবারেই কম, কিন্তু এক বিষয়ে সে অত্যন্ত লোভী। আর তা হচ্ছে নিজেকে সফল বিজনেসম্যান  হিসেবে গড়ে তোলার এক অদম্য লোভ। যদিও সে ম্যাথমেটিক্সে ভালো রেজাল্ট করেছে সব সময় তারপর ও সে মনে করে গুজরাটী হিসেবে ‘বিজনেস’ তার রক্তের সাথে মিশে আছে। তাই এ ব্যাপারে সে দৃড় প্রতিজ্ঞ। বিজনেসে আসার আরেকটি কারণ হচ্ছে তার পরিবারের দারিদ্রতা। পরিবারের সদস্য বলতে যদিও আছে শুধুমাত্র তার মা, তারপরও সংসারের হাল সামলাতে তার মায়ের ‘পিঠা’ সাপ্লাইয়ের ব্যাবসায়ের পাশাপাশি করতে হয় তাকে ম্যাথমেটিকসের টিউশনি।  আর মনে মনে বুনতে থাকে তার ব্যাবসায়ের পরিকল্পনা।

তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা হচ্ছে ‘ইশান’ আর ‘অমি’, যাদের সাথে তার একটি দিন না কাটালে নয়। তাই এই দুই বন্ধুকে নিয়েই সে একসময় শুরু করে ‘ক্রিকেট শপ’।
পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকে তার টিউশনি।  এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে তিন বন্ধুর গল্প সামনের দিকে, আসতে থাকে ধর্মীয় গোড়ামী, রাজনীতি বা নিঃস্ব হউয়ার দীর্ঘশ্বাস...আর গল্পের পরিক্রমায় একসময় আপনি গোবিন্দকে বিদ্যার প্রেমেও পড়তে দেখবেন যে কিনা তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইশানের ছোট বোন।  অষ্টাদশী বিদ্যা হচ্ছে ইশানের ছোট বোন, যাকে ইশান সব সময় আগলে রাখে অন্যান্য ছেলেদের থেকে। আর এই বিদ্যাকেই কিনা একসময় পড়ানোর দায়িত্ব এসে পরে গোবিন্দর ঘাড়ে। গোবিন্দও পড়ায়, বিদ্যাও ‘পরে’...  পা বাড়াতে থাকে ভুল এর দিকে...  জীবনের করা তিনটি ভুলের একটি ভুলের দিকে...

উপন্যাসের বেশীরভাগ ফ্রেম আপনি দেখতে পাবেন গোবিন্দর চোখ দিয়ে অর্থাৎ তার দেখা আর উপলব্ধি করা বিষয়গুলোই আমরা উপন্যাসের বেশিরভাগ জুড়েই দেখতে পাবো। অর্থাৎ তার চোখ দিয়েই উপন্যাসের বাকি ক্যারেক্টার গুলো ফুটে উঠেছে, সেটা ইশানের জীবণই হোক, অমিরটাই হোক,বা বিদ্যারই  গল্প হোক না কেন। উপন্যাসের প্রতিটা পেজ আপনাকে নিয়ে যেতে থাকবে সামনের দিকে...


পেপারবুক ভার্সনঃ পেপারবুক ভার্সন পেতে পারেন ‘বলাকা’ সিনেমা হলের পাশের মার্কেট ‘ফ্রেন্ডস বুক কর্ণার’ থেকে। দাম রাখবে ৩০০ টাকার মধ্যে।

ই-বুক ডাউনলোড লিঙ্কঃ http://swameworld.mywapblog.com/files/three-mistakes-of-my-life.pdf

একজন সেলিম স্যার...ও আমার চতুরঙ্গ আসক্তি

আমি দাবা খেলতে অসম্ভব ভালোবাসি, তবে তা অবশ্যই আমার থেকে ভালো প্লেয়ারদের সাথে। অনেক কিছু শিখা যায় দাবা খেলার প্রতিটা চালে। তবে যতোটা না শিখা যায়, তার থেকে বেশী বুঝা যায় অপর পাশে থাকা মানুষটি সম্পর্কে। তার দৈনন্দিন জীবণের চাল চলন, অভ্যাস, স্ট্রেস নেওয়ার ক্ষমতা, স্ট্রেস দেওয়ার ক্ষমতা, টেম্পার লেভেল... আরো অনেক কিছুই বুঝা যায়,  যদি কিনা আপনি একটু ভালোভাবে খেয়াল করেন।

আমি অনেক দিন হলো ‘সত্যিকার অর্থে’ দাবা খেলি না। ‘সতিক্যার অর্থে’ বলতে বুঝিয়েছি ‘সত্যিকার অর্থে’, অর্থাৎ ৩২ টি দাবার ঘুটি আর একটি দাবার বোর্ড নিয়ে আমার এখন খেলতে বসা হয়ে উঠে না আর। হয়ে উঠে না কারণ খেলার মতো কোনো পার্টনার খুজে পাই না আর। তবে আমার খেলার প্রচন্ড ইচ্ছে সব সময়ই করে, এবং আমি খেলিও। কিভাবে খেলি তার ব্যাখ্যা পরে করি, আগে বলি আমার দাবার প্রতি আসক্তির কথা। আমি দাবার প্রতি এতটাই আসক্ত যে, প্রতিদিন রাতে অফিস থেকে কাওরান বাজার রেললাইন ধরে হেটে আসার সময় দেখি একজোড়া মধ্যবয়সী খেটে খাওয়া দিনমুজুরেরা দাবা খেলতেছে... আর আমিও প্রতিদিন ঐ যায়গাতে এসে দাঁড়িয়ে যাই। আশ পাশের ভিড় ঠেলে কোনো রকমে দেখার চেষ্টা করি কার কি অবস্থান। তার থেকেও বেশী দেখি তাদের এক্সপ্রেশন। ওদের এক্সপ্রেশন গুলো হয় একেবারেই প্রাকৃতিক, যখন যা অনূভব করছে তা ই প্রকাশ করছে গালিতে, মাঝে মাঝে নিজের উপর জেদ করে, মাঝে মাঝে দাবার গুটির উপর জেদ করে, আর বেশীরভাগ সময় প্রতিপক্ষের উপর জেদ করে। তবে খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে, এই ধরণের এক্সপ্রেশন আপনি শিক্ষিতদের খেলার সময় দেখবেন না। তাই আমি শিক্ষিতদের খেলা দেখিও না। নিজের ভিতরে আটকিয়ে রাখা অভিব্যাক্তি জোড় করে খুঁজতে যাওয়ার কোনো মানে আমি দেখি না। তাই খুঁজতে যাইও না। আমি দেখি আমার মতো নিন্মবিত্তের দাবা খেলা... ততোক্ষণ, যতক্ষণ না আমার ঘড়ি আমাকে জানান দেয় বাসায় যাওয়ার জন্য।

আবার কেউ যদি আমাকে রাত ২ টার দিকে গভীর ঘুম থেকে তুলে বলে দাবা খেলার জন্য... আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে চোখ ধুয়ে দাবার বোর্ড সাজানো শুরু করবো। তবে শর্ত একটাই, আর তা হচ্ছে প্রতিপক্ষ হতে হবে রক্ত মাংসের মানুষ। কোনো AI হলে চলবে না। কারণ আমি কম্পিউটারের সাথে খেলে কখনোই মজা পাই না, তাই খেলিও না। কারণ কম্পিউটারের সাথে খেলার সময় আমি প্রতিপক্ষের অভিব্যাক্তি দেখার কোনো সুযোগ পাই না। একজন প্রতিপক্ষ যে সে ঘোড়া হারলে কি রকম অনূভব করে, বা একটা রথ হারালে কি রকম অনূভব করে, তা ই যদি দেখতে না পারি তাহলে সেই দাবা খেলা আর সাপ লুডু খেলার মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। খেলতে হবে টান টান উত্তেজনায়... প্রতিপক্ষের শুধু পূর্ববর্তী চাল দেখেই নয়, বরং প্রতিপক্ষের চোখ এবং অভিব্যাক্তি দেখে বুঝতে হবে তার পরবর্তী চাল কি হতে যাচ্ছে। আর তা আপনি বুঝতে পারবেন একজন প্রতিপক্ষের প্রতিটা চালের সময়, ধরণ, স্ট্রেটেজি এবং বিভিন্ন গুটির প্রতি তার ভালোবাসা দেখে আপনি খুব সহজে বুঝতে পারবেন সে কি রকম, তার কি রকমের গান পছন্দ, সে কি রকমের খাদ্যভাষে অভস্থ্য, এবং সে কি প্রকৃতির মানুষ। আমি ফাও কথা বলছি না। এর পিছনে আমার একটা দুইটা না বরং ৩২ টি গুটির উপর ভিত্তি করে ৯ রকম লজিক, গুটির মুভমেন্টের উপর ভিত্তি করে ৮ রকম লজিক, সময় এবং গুটি কয়েক গুটির উপর ভালোবাসা ভিত্তি করে আরো ৩ ধরণের লজিক রয়েছে। সেগুলো এখন যদি বর্ণনা করা শুরু করি তাহলে সব লিখতে লিখতে সারা রাত পার হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে আর কথা এগুতে চাচ্ছি না।
আচ্ছা দাবার বিষয়ে কথা পরে বলি, এখন একটা স্মৃতির কথা বার বার মাথায় আসছে... সে বিষয়ে লিখতে ইচ্ছে করছে...

আমি যখন ক্লাস সেভেনে কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়ি তখন আমার বাসা থেকে ‘সেলিম স্যার’ নামে একজন স্কুল শিক্ষক ঠিক করে আমার মা। সেই স্যারের দ্বায়িত্ব ছিল আমাকে মারতে মারতে অঙ্কের বই গিলানো। তিনি আমাদের বাসায় এসেও পড়াতো, আবার আমিও উনার বাসায় যেতাম পড়তে। দুই জায়গায় পড়তে গেলেও একটা জিনিস দুই জায়গাতেই একইরকম ছিল... আর তা হচ্ছে ‘মাইর’...তবে দুই জায়গায় দুই রকম ভাবে মাইর খেতাম আমি। স্যারের বাসায় মারতো মোটা জালি বেত দিয়ে (সাথে হাতের মাইর থাকতো), আর আমাদের বাসায় মারতো শুধু হাত দিয়ে। তবে মাইর কখনো মিস হতো না। আমি অবশ্য কান্নাকাটি, বা আঃ উঃ করতাম না। যত মাইরই খাই না কেন, মুখ দিয়ে কখনো আওয়াজ করতাম না। আর পাশাপাশি চেষ্টা করতাম যথাসম্ভব কান্না চেপে রাখার জন্য।

আপনাদের একটা জিনিস বলে রাখা ভালো, আমি কিন্তু মোটেও দুষ্ট স্বভাবের ছেলে ছিলাম না। আমি সারাদিন বাসাতেই ম্যাচের কাঠি, পিপড়া, ভাঙ্গা যন্ত্রপাতি দিয়ে নিজের মতো করে খেলতাম, কাউকে কখনো বিরক্ত করতাম না। মায়ের কাছে কাছে কখনোই টাকা চাইতাম না... চিপস কিনবা চকলেট খাওয়ার জন্য। আমাকে স্কুলে যাওয়া আসার জন্য ২০ টাকা দিত, আমি স্কুলে হেটে হেটে যেয়ে ১০ টাকা করে প্রতিদিন জমাতাম। এভাবে ২ তিন মাস জমানোর পর আমার মা আমাকে বলতেন, “টাকা পয়সা ছেলেমেয়েদের হাতে দেওয়া ঠিক না”, এই কথা বলে উনি সব টাকা নিয়ে যেতেন, তারপর ঐ টাকা থেকে দুই তিনটা চিপস আর কিছু চকলেট কিনে দিয়ে বাকি টাকা নিজের কাছে রেখে দিতেন। আর আমি তাতেই খুব খুশী হতাম। একসাথে তিন চারটা চিপস আর চকলেট তো খাইনি কোনোদিন, তাই আরকি।

আবার আমার কিন্তু কোনো বন্ধুও ছিল না। কারণ আমাকে আমার মা স্কুল বাদে কখনোই ১ মিনিটের জন্য বাহিরে থাকতে দেয়নি বা কারো সাথে মিশতে দেই নি। এমনকি বিকেল বেলাতেও বাসাতে থাকতাম... খেলতাম নিজের মতো করে। আর তা নিয়ে আমার কখনোই কোনো ক্ষোভ ছিল না। একটা কুয়োর ব্যাঙ যে কিনা আজীবণ কুয়োর ভিতরেই বাস করেছে, তার জানার কথা না বাহিরের দুনিয়ায় বিকেল বেলা কি হচ্ছে। তার কাছে কুয়াতেই স্বর্গবাস, কুয়াতেই নরকবাস।

আমার শুধু একটাই সমস্যা ছিলো... আর তা হচ্ছে আমি স্কুলের বেশীরভাগ পরিক্ষার বেশিরভাগ বিষয়ে ফেল করতাম। ইসলাম ধর্মে ফেল করতাম আরবী পারতাম না দেখে, সমাজ বিজ্ঞানে ফেল করতাম ইতিহাস জানি না দেখে, বাংলায় ফেল করতাম হাতের লেখা ভালো ছিলো না বলে, ইংলিশে ফেল করতাম বুঝতে সমস্যা হতো দেখে, আর গণিতে ফেল করতাম মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতাম না দেখে... বা বুঝার চেষ্টা করতাম না। আমার মন পরে থাকতো আমার ফেলে আসা শৈশব রাঙ্গামাটিতে, যেখানে ৫ কিমি এর বেশী পাহাড় পর্বতের রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্কুল থেকে প্রতিদিন ফিরতাম বাসায়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফিরতাম বাসায়.... যেদিন রাঙ্গামাটি ছেড়ে কুমিল্লায় চলে যাচ্ছিলাম, সেদিনও বুঝতে পারিনি যে আমি কি হারাতে যাচ্ছিলাম...

কুমিল্লার ধুলা বালি মাখা সমতল ভূমি আমার মনটাই ভেঙ্গে দিয়েছিল একেবারে ভিতর থেকে... ফেল করতে লাগলাম প্রিতিটি শ্রেণীর প্রতিটি পরিক্ষায়... তাই আমার পিছনে আমার মা মাষ্টার লাগিয়ে রেখেছিল শুধুমাত্র আমাকে পড়া গিলিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা বাসায় এসে আমাকে হা করিয়ে পড়া গিলানো শুরু করতো, কেউ গেলাতো আদর করে, কেউ গেলাতো শাসন করে.. এক একজন মাষ্টারের পড়া গিলানো ধরণ ছিলো এক এক রকম। ইসলাম শিক্ষার জন্য যে স্যারের কাছে পড়তাম, তিনি অত্যন্ত আদর করে পড়াতো। ৪ বছর উনার বাসায় যেয়ে পড়েছি কিন্তু তিনি একটা দিনও আমার গায়ে হাত তুলে নাই। আমি মাঝে মাঝে লজ্জা পেতাম ইসলাম শিক্ষায় ফেল করার পড়। ভাবতাম হজুর স্যার কে মুখ দেখাবো কিভাবে...

আর গরু যেভাবে পেটায়, সেলিম স্যার আমাকে সেভাবে মারতো। আমার আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আত্মভিমান মারাত্বক রকমের ছিলো। হাত দিয়ে কেউ মারলে ইচ্ছে হতো মরে যেতে... তারপরও সেলিম স্যার প্রতিটা দিন আমার ঘাড়ে, মুখে, কানে...মাথায়... ইচ্ছা মতে মেরেছে হাত দিয়ে... কারণে অকারণে... মাঝে মাঝে শুধু শুধু...আস্তে আস্তে সেলিম স্যার আমার কাছে যমের মতো হয়ে গেলো, কিংবা জমের চাইতেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশী। সেলিম স্যারের সামনে ভয়ে আমি সোজা হয়ে দাড়াতে পারতাম না, হাটুগুলো ভেঙ্গে দাড়াতাম। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় এটা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল... দাড়াতাম ঠিক একটা লুলার মতো... হাটু থেকে দুই পা ভেঙ্গে... এই জিনিসটা সেলিম স্যার খুব এনজয় করতো। মাঝে মাঝে অন্য স্যারেরা তার বাসায় বেড়াতে আসলে আমাকে বলতো উঠে দাঁড়ানোর জন্য। আমি উঠে দাড়াতাম। তারপর আমাকে তিনি বলতেন একটু দূরে যেয়ে দাঁড়ানোর জন্যে, যাতে করে উনি এবং উনার দর্শকেরা ভালোভাবে দেখতে পারে যে ‘আমি লুলাদের মতো হাটু ভেঙ্গে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে আছি’... আমাকে এই রকম শুধু একবারই নয়... বার বার দাড়াতে হয়েছিল। এবং শুধু স্যারের বাসাতেই নয়... আমাদের নিজ বাসাতেও মাঝে মাঝে এভাবে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে কিছু দর্শকদেরকে মজা দেওয়া লাগতো। আর বেশীরভাগ সময় দর্শকদের মডারেটদের ভূমিকা আমার ‘মা’ পালন করতো। তিনি সেলিম স্যারকে অনুরোধ করতো, আমাকে দাড়াতে বলার জন্য। সেলিম স্যারও আমাকে দাড়াতে বলতো, আমিও দাঁড়াতাম, আর দর্শক সারির সবাই তা এনজয় করতো। এমনকি আমার মা ও !!!

সেলিম স্যারের মাইর দেওয়ার পছন্দের জায়গা ছিল ‘আমার মাথা’, আমার মাথায় তিনি একটু পর পর শুধু থাপ্পড় দিতো, পাশে দেয়াল থাকলে দেয়ালের সাথে বাড়ি লাগতো মাঝে মাঝে......................................................


আমি কয়দিন আগে স্নাতক পাশ করেছি। অনেকদিন হয়েছে কোনো স্যারদের হাতেও মার খাই না। কিন্তু এখনো যদি কেউ আমার মাথায় আদর করে হাত রাখে, আমার পুরো শরীর কেপে উঠে এক অজানা কারণে। ইচ্ছে করে যে হাত রেখেছে, তার হাত দুটো ভেঙ্গে ফেলতে...

আমি হয়তো কখনোই সেলিম স্যারকে আমার মাথা হতে তাড়াতে পারবো না। আমার হারানো শৈশবে যে বিষ আমার মা আর সেলিম স্যার আমার মাথায় গেঁথে দিয়েছে, সেই বিষ নিয়েই হয়তো আমাকে শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে...
এখনো আমার মাঝে মাঝে মাঝ রাতে চিৎকার করে করে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার বন্ধু রিজভী তখন আমাকে শান্ত করে আমার ভুল ভাঙ্গায় যে, আমি আমার স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম... বাস্তবে না... আমিও আবার ঘুমের মধ্যে ঘুমিয়ে যাই। সে ও বুঝতে পারে এগুলা হচ্ছে আমার দুঃস্বপ্ন...কিন্তু সে বুঝতে পারে না আমি আমার স্বপ্নে কি দেখিছি... কেউ ই কখনো পারবে না... নিজের দুঃস্বপ্ন নিজেকেই আজীবণ লালন করতে হয়।
কিন্তু আমাকে বুঝতে হয় কে কিরকম। তাই আমিও মনে মনে ছক কেটে দাবা খেলি সবার সাথে... আমার পরিবারের লোকজনদের সাথে, আমার বন্ধুদের সাথে, বা আমার অফিসের কলিগদের সাথে। আমাকে বুঝতে হয় কেউ কি আবার সেলিম স্যারের মতো আমার ঘাড়ে অদৃশ্যভাবে থাপ্পড় দিয়ে আমাকে লুলা বানিয়ে দর্শকদের কাছ কাছ থেকে হাত তালি নিচ্ছে নাকি।  মাঝে মাঝে মনে হয় থাক করুক, হোক মাঝে মাঝে তার সেলিম স্যার। সেলিম স্যার হউয়ার মাঝেও আলাদা একটা পাশবিক মজা আছে। আমিও তো করি, আমিও তো হই...মাঝে মাঝে একজন ‘সেলিম স্যার’।